খুঁজে ফিরি আমাদের সেই শৈশব
ছেলেবেলায় প্রথম বাসায় টিভি কেনা হয়েছিল যখন আমি ক্লাস ওয়ানে পড়ি।গোটা গোটা হাতের লেখায় আমাকে হলফ নামা লিখতে হয়েছিল। পরীক্ষার সময় টিভি দেখব না। রাত ৮:৩০ এর আগে টিভি দেখতে চাইব না। শুক্রবার কেবল নতুন কুঁড়ি দেখতে পাব।এই সেই! হ্যান তেন বহু কিছু!
এত এত শর্ত সাবুদ মেনে অবশেষে আমার শিশু জীবনের অন্যতম খুশির উপাদান সাদা কালো টিভি খানা ঘরে এসেছিল।
তখনকার সময়ে আনন্দ ফূর্তি খুশির খোড়াক প্রায় সবার জীবনেই এই সাদা কালো বাক্স খানা,রেডিও তে শোনা ছায়াছবির গান আর আত্মীয় বাড়ীতে বেড়াবার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।
তখন মোবাইল ফোন ছিল না।এমন কি টেলিফোন রিসিভার কানে নিয়ে ঘন্টা পার করবার সুযোগ ও ছিল না অনেকেরই।
স্কুল থেকে ফিরে বিনা নোটিশে অতিথির আগমন ছিলো জীবনে হঠাৎ দেখা রংধনুর মতো আনন্দময় ঘটনা।
স্কুলের বারান্দায় দুই শালিখ দেখে চুমু খেতে খেতে কত বার প্রার্থনা করেছি বাসায় যেন মেহমান আসে।
আত্মীয়দের সাথে গল্প করা।মজার মজার পিঠা পুলি খাওয়া।কিংবা তাদের সাথে করে অন্য আত্মীয় বাড়ী যাওয়া। এইটুকুন ই কত না খুশির বন্যা বইয়ে দিত জীবনে।
সারা বছর ধরে প্রতীক্ষা থাকত কবে পরীক্ষা শেষ হবে?কবে দাদা বাড়ী যাব?কবে নানা বাড়ী যাব?
ভোর রাতে ঘুম থেকে উঠে ভালো পোষাক পরে শুকনো খাবার সাথে নিয়ে সুদীর্ঘ লঞ্চ যাত্রার পরে দাদাবাড়ীতে পৌছতাম।
আর দাদাবাড়ী থেকে নৌকা করে দিনভর নৌকা ভ্রমণের পরে গোধুলী লগ্নে নানা বাড়ীতে পৌছে যেতাম।
দীর্ঘ যাত্রার কষ্ট মুছে যেত মুরুব্বীদের আদরের অতিশয্যে কিংবা সমবয়সীদের সাথে খুনসুটিতে।
আর সেই শিউলি ঝরা সকাল।ঝরা বকুলের মালা।জবা ফুলের পুতুল ঘর।ভুঁই চাপার অরন্যে হারিয়ে যাওয়া।শাপলার বিলে নৌকা চড়া।নাম না জানা সব ফুলের মালায় বউ সাজা।বড়দের সাথে সাথে মাছ ধরা।টিয়া পাখির বাসাতে বাচ্চা খোঁজা।
যেন চোখের পলকে শৈশব টা ফুরিয়ে গেলো।দুর্বার প্রতিযোগিতাময় কৈশোরে পা রাখলাম।এবার জীবনের জানালা হলো বই আর মাঝে মাঝে গ্রামে ভ্রমন।
আস্তে আস্তে তাও হারিয়ে গেলো।
পুরো পৃথিবীটাই বদলে গেছে।বদলের হাওয়া আমি সহজে নিতে পারি না।
আমি পার্কে যাই,রেষ্টুরেন্টে যাই,ফেসবুকে উকি ঝুঁকি দেই।
নাহ। এখনকার শিশুরা ব্যস্ত মোবাইল,ট্যাব,কম্পিউটার নিয়ে। শিশু পোষাক কিংবা শিশু সাজ বলে কিছু নাই।যেন এরা চিরযৌবনা।এই কন্যা শিশুদের পোষাকে আচরনে অভিব্যক্তিতে শিশুসুলভ কিছু নাই।তাদের চোখের চাহুনীতে শৈশবের সরলতা নাই।কৌতুহল নাই।আই শ্যাডো আর আইলাইনারে আঁকা চোখে তরুনী সুলভ আবেদন আছে।আবিষ্কারের উচ্ছলতা নেই।
এই শিশুদের জীবনে পুতুল খেলা নেই।
ফুলের কলি,পাপড়ি কিংবা সুঘ্রানে কারো শৈশব জড়িয়ে নেই।
আমি তাই রিক্সা নামক তিনচক্র যানে বেড়িয়ে পরি।শহর থেকে দূরে অলিতে গলিতে গ্রাম্য প্রকৃতির মাঝে পড়ন্ত বিকেলে কিংবা সাঁঝের আঁধারে আমি আমার শৈশবকে খুঁজি।
শান্ত জলাধারের পাশে ছোট্ট টিনের ঘরের টিমটিমে বাতির আলোয় আলো আধাঁরির বৈঠক খানা পার হতে হতে উঠোনে খেলায় ব্যস্ত শিশুদের মাঝে আমি আমার ছেলেবেলাকে ফিরে পাই।
পথ চলতে চলতে স্বপ্ন দেখি,একদিন এমন ই এক গ্রাম্য কুটিরে আবাস হবে আমার।ঝিঁ ঝিঁ ডাকা প্রান্তরে জোনাকীর আলোয় ঘিরে থাকবে আমার কুটির।বুনো ফুলের সুবাসে হারিয়ে যাবো কোন অজানায়।সেই সপ্নের ঘর আমি কখন ও কি পাবো নাকি নগঢ় জীবন ধীরে ধীরে গ্রাস করবে আমাকে,গলা টিপে মেরে ফেলবে আমার এই স্বপ্নকে!
নাকি আমি এমন ই রইব আমৃত্যু,মাঝে মাঝে উকি দিয়ে আসব নিজের সহজ সরল প্রকৃতির কাছাকাছি কাটানো ছেলেবেলাকে!ছুঁয়ে আসব আমাকে,আমারই অজান্তে সবার অলক্ষ্যে চুপিচুপি নীলিমায়!
ডা. শিরীন সাবিহা তন্বী