RIP বাংলাদেশের মেডিকেল শিক্ষা ব্যবস্থা

মেডিকেল

RIP বাংলাদেশের মেডিকেল শিক্ষা ব্যবস্থা।

_______________________________

সুইসাইড নোট লিখেও ছিঁড়ে কুটি কুটি করে ফেলল পর্শিয়া। এই নিয়ে এগারোবার করল এই কাজটা। সুইসাইড কিভাবে করবে তার প্ল্যান পর্যন্ত ছকে লিখে ফেলেছে তিন মাস আগে। তার পছন্দ হচ্ছে— ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমের মধ্যেই এই নরকসম পৃথিবীকে টাটা বাই বাই বলা।

সুইসাইড নোটটা লিখবে এনাটমীর ডিপার্টমেন্টাল হেড স্যার আর A ব্যাচের ব্যাচ টিচার ম্যাম আর তার দুই রুমমেটের কাছে। যে মানুষগুলো জন্য গত দুটো বছর ধরে এনাটমীতে সাপ্লি খেয়ে যাচ্ছে সে সমানে। অথচ সে যাদেরকে হার্ডপার্ট সফর্ট পার্ট ডেমো দেয় সবাই পাশ করে থার্ড ইয়ারে চলে যাচ্ছে।

পর্শিয়া লেখাপড়া করেছে দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গার্লস স্কুল এবং কলেজে । ক্লাস ওয়ান থেকেই রেজাল্ট প্রথমদিকে। গনিত অলিম্পিয়াড থেকে শুরু করে সাইন্স ক্লাব,ডিবেট ক্লাব, মিউজিক ক্লাস সব জায়গাতেই ছিল তার উচ্ছল পদচারনা। চমৎকার হাসিখুশি মিশুকে স্বভাবের জন্য আশেপাশের সবার প্রিয় পাত্রী হয়ে যায় সে সহজেই।

মেডিকেল কলেজে এসে খানিক ছন্দ পতন ঘটে তার পথচলাতে। জীবনে এই প্রথম আব্বু আম্মু ভাইকে ছেড়ে বাসার বাইরে প্রাণ প্রিয় শহর ঢাকা ছেড়ে একেবারেই অচেনা শহরে এসে হোস্টেলে থাকা। মন মরা থাকতো সারাদিন। সেই সাথে মেডিকেলের প্রচন্ড লেখাপড়ার চাপ একেবারে শুরু থেকেই তাকে বেদিশা করে দিচ্ছিল। পাশাপাশি দুই রুমমেট ছিল দুজনের পূর্ব পরিচিত।ওরা ব্যস্ত থাকতো নিজেদের নিয়ে।
ফলে ওদের সাথে তেমন সখ্যতা গড়ে উঠলো না পর্শিয়ার।

সে ছিল A ব্যাচের স্টুডেন্ট। ব্যাচ টিচার ছিলেন ডা. রিভা ম্যাম। কোন এক অদ্ভুত কারনে একদম শুরু থেকেই ম্যাম ওকে পছন্দ করতেন না। ওর শব্দের উচ্চারণ নিয়ে খুব অপমান করতেন ম্যাম ওকে। ছোটবেলা থেকেই ল আর র উচ্চারণে গোলমাল করত ও। একটু আদুরে ভাব চলে আসতো ওর কথা বলার সময়ে। এটাতে ম্যাম খুব বিরক্ত হতেন।পুরো ব্যাচের বিশ জন স্টুডেন্ট সামনে বলে বসলেন—- এটা এনাটমী ডিসেকশন ক্লাস। ন্যাকামো ক্লাস না।
এত লজ্জা পেয়েছিল সেদিন পর্শিয়া।দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে চোখের জল আটকাতে হয়েছিল তাকে।

সেই শুরু এনাটমীর প্রতি ওর আতঙ্কের। একের পর এক আইটেম পেন্ডিং হতে লাগলো। পুরো এবডোমেন কার্ড ফাঁকা পরে রইলো। অন্য কার্ডগুলোতেও সে খুবই অনিয়মিত আইটেম দিত। দিলেও ক্লিয়ার হতো না।অথচ বায়োকেমিস্ট্রি আর ফিজিওলজি সব আইটেম কার্ড, এসিসমেন্টে দারুন নম্বর ছিল তার। রেগুলার ব্যাচের সাথে সে ক্লিয়ারেন্স পেল না এনাটমীতে কার্ড ক্লিয়ার না থাকায়। শুরু হলো পিছিয়ে পড়ার। এর পরের টার্মে সব আইটেম ক্লিয়ার করার পরেও হেড অব ডিপার্টমেন্ট ডা. কুদরত স্যার ক্লিয়ারেন্স আটকে দিলেন ঠিক আগের দিন। বললেন ওকে সবগুলো কার্ড ফাইনাল এবং এসিসমেন্ট আলাদা আলাদা করে ক্লিয়ার করতে হবে। স্যারের শুধু পায়ে ধরা বাকি রেখেছিল পর্শিয়া। ও অনুরোধ করেছিল স্যার একদিনে সবগুলো পরীক্ষা নিয়ে নিন।আমি পারব। স্যার আর ম্যাম বললেন—- তা কিভাবে সম্ভব ? ছয়টা কার্ড আর ছয়টা এসিসমেন্ট বারো দিনে দিবে। এই টার্মে তো সম্ভব না। নেক্সট বারের জন্য ট্রাই কর। এখন বের হয়ে যাও রুম থেকে।

চলে গেল একটা বছর। ফার্ষ্ট প্রফে বসা হলো না পর্শিয়ার। ওর ব্যাচমেটরা তখন তৃতীয় বর্ষে পড়ছে। রুমমেট দুজন রোজ হাসপাতাল থেকে ফিরে জোরে জোরে নতুন ক্লাসের গল্প শুরু করে দেয়। ওরা ঘুমিয়ে পড়লে পর্শিয়া কাঁথার নীচে টেবিল লাইট জ্বেলে লেখাপড়া করে। নিজের কাছে ভেতরে ভেতরে শেষ হয়ে যাচ্ছিল রোজ রোজ সে।

মানসিকভাবে ভীষন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল তখন সে।
ঘুম হচ্ছিল না একেবারেই । খাওয়ায় অরুচি হচ্ছিল। ওজন কমে যাচ্ছিল দ্রুত।মানুষ দেখলেই কেমন যেন নোংরা নোংরা লাগছিল। তখনই প্রথম সুইসাইডের কথা মাথায় এল তার।একদিন নিজেই হাসপাতালের সাইক্রিয়াট্রি ডিপার্টমেন্টে গেল ম্যামের সাথে কথা বলার জন্য। নিজেই বুঝতে পারছিল তার চিকিৎসা দরকার। কিন্তু তখন ঐ ডিপার্টমেন্টে ক্লাস করছিল তার ব্যাচমেটরা। পর্শিয়া কে দেখে তারা ফিসফাস শুরু করে দিল— আহারে বেচারি। আর কতদিন ফার্ষ্ট প্লফে ঝুলে থাকবে।মনে হয় মেন্টাল সমস্যা দেখা দিয়েছে। ইত্যাদি।
ম্যামের সাথে দেখা না করেই দৌড়ে পালিয়েছিল সাইক্রিয়াট্রি ডিপার্টমেন্ট থেকে পর্শিয়া।

বাবা মাও হতভম্ব হয়ে গেছে তার এত অধঃপতন দেখে লেখাপড়া তে। একমাত্র ভাইয়া ওকে সাপোর্ট করে যাচ্ছে। ভাইয়া নিজে ডাক্তার। পরিস্হিতিটা বুঝতে চেষ্টা করছে।

এই টার্মে ক্লিয়ারেন্স পেয়ে প্রথমবারের মতো প্রফে বসল পর্শিয়া। বায়ো আর ফিজিও দুর্দান্ত পরীক্ষা হয়েছে তার।এনাটমী রিটেনও ফাটাফাটি।কিন্তু ভাইভা বোর্ডে কুদরত স্যার আর রিভা ম্যাম এক্সটার্নাল স্যারকে বলতে ছাড়লেন না তার ক্লিয়ারেন্স না পাবার গল্পটা।
তাকে এত ছোট করে রসিয়ে রসিয়ে পুরো ঘটনা বললেন দুজনে মিলে যে পর্শিয়ার ইচ্ছে হচ্ছিল টেবিলে ট্রেতে থাকা ফিমার দিয়ে নিজের মাথায় নিজের বাড়ি মারতে।

পরীক্ষা শেষে পর্শিয়া বাসায় আসেনি। মেডিকেল এর হোস্টেলে থেকে গেছে। জানে তো ফেইল করবে এনাটমী ভাইভাতে, এই মুখ কিভাবে বাবা মাকে দেখাবে?

আগামীকাল রেজাল্ট হবে শোনা যাচ্ছে। আজকে সুইসাইড করে ফেলতেই হবে। আর দরকার নেই ডাক্তার হবার। ডাক্তার হলেও সবাই বলবে ফেইল করতে করতে পাশ করেছে। অথচ পর্শিয়া জানে সে লেখাপড়া তে মোটেই ফাঁকি দেয়নি। হুমমম মেডিকেলের লেখাপড়া বুঝতে তার একটু সময় বেশি লেগে গেছে।

সময় বেশি নেই। এখন বাজে সন্ধা ছয়টা। যা করতে হবে আজ রাতেই করতে হবে। সিডেটিভ জোগাড় করা মোটেই সহজ কাজ ছিল না। ফার্মেসীর মামারা একসাথে বেশি দিতে চান না। কয়েকমাস সময় নিয়ে তিনটা চারটা করে বিশটা জমা করেছে।

রুমের দরজায় নকের শব্দ হলো। দরজা খুলে দেখে রান্নার খালা দাঁড়িয়ে। বলল—- আপনার ভাই আসছে।নীচে গেস্ট রুমে। ডাকে আপনাকে।

ভাইয়া !! এখন।চমকে গেল পর্শিয়া। দৌড়ে সিঁড়ি ভেঙে নীচে ছুটে এলো।ওকে দেখে ভাইয়া উঠে দাঁড়াল।ভাইয়া বলে জড়িয়ে ধরে নিজেকে আর সামলাতে পারল না পর্শিয়া। কাঁদতেই থাকলে অঝোর ধারায়।
ভাইয়া মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল — কি হয়েছে তোর ? চেহারা কি বানিয়েছিস ? কেন আমাকে সব জানাস নি? চোখ মুছিয়ে দিয়ে পাশে বসিয়ে ভাইয়া বলল— আমি সব জেনেছি। আমি তো জানি তুই কেমন ছাত্রী। এক টার্মে সাপ্লাই খেতে পারিস তাই বলে ক্লিয়ারেন্স আটকে রাখা ? তুই তো এসব কিছুই বলিস নি আমাদেরকে।বলেছিস প্রফে খারাপ করছিস তুই।
আমার বন্ধু সদর হাসপাতালে জয়েন করেছে এখানকার।ওকে দিয়ে সব খবর নিয়েছি আমি।
চলে আমার সাথে তুই। মেডিকেলে আর পড়তে হবে না তোকে। তোর সব পেপার্স পাঠিয়েছি বোস্টন ইউনিভার্সিটিতে। ওরা পেপার্স একসেপ্ট করেছে।
ঢাকায় ফিরে জাষ্ট IELTS দিয়ে দেশ ছাড়বি তুই। গত পাঁচ মাসে দেশে ছয়জন মেডিকেল শিক্ষার্থী সুইসাইড করেছে।আমি আমার বোনকে হারাতে পারব না। তুই সব গুছিয়ে নে।আমি হল সুপার আর প্রিন্সিপালের সাথে কথা বলে সব ব্যবস্থা করছি।

ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠলো পর্শিয়ার। ভাইয়ার গলা জড়িয়ে বলল —- সত্যিই ভাইয়া তুই আমাকে এই জেলখানা থেকে নিয়ে যেতে এসেছিস?

ভাইয়া শক্ত করে হাত ধরল পর্শিয়ার। ভাইয়ার চোখের কোল ঘেঁষে এক টুকরো জল গড়িয়ে পড়ল মেঝেতে।

ফুটনোটঃ
দরকার নাই ডাক্তারী পড়ার এই দেশের বিশ্রী সিস্টেমে।
নিজের ভাই বোন ছেলে মেয়ে বন্ধুর জীবনটা জরুরী আমাদের কাছে।

মেডিক্যাল

# মিম্ মি

Related posts

Leave a Comment