[একজন মহিয়সী নারীর একটা শিক্ষনীয় গল্প বলছি। গল্পটা আমার নিজের জন্যই আমাকে সৃষ্টি করতে হয়েছে!]
(১)
তিনি যোগ সাধনা করেন, মন্দিরে থাকেন, উনার ভক্তরা উনাকে মা বলে ডাকেন। মায়ের কাছে একবার এক লোক এলেন যিনি একেবারেই চঞ্চল প্রকৃতির মানুষ, সংসারে মন নেই, কাজে কর্মে ভীষন অস্থির। কেউ একজন উনাকে বলেছেন, মনে ভক্তি ভাব জাগ্রত হলে মন স্থির হবে, সবকিছুতেই স্থিতি আসবে এবং তার সামগ্রিক উন্নতি হবে।
মায়ের কাছে এসে ওই লোক বললেন, মা আমাকে আশীর্বাদ দিন যেন আমার ভক্তি হয়। মা তাকে আশীর্বাদ করলেন, আর বললেন, বাবা ভক্তি হবার জন্য কাজ করে যাও, মাঝে মাঝে এদিকে এসো!
দিন যায়, সেই লোক আর আসেন না। কয়েকদিন পর তিনি হন্তদন্ত হয়ে এলেন, মা! মা! আপনার আশীর্বাদ আমার কোন কাজেই আসেনি, আমার অস্থিরতা আরো বেড়েছে। মা আমার তো মনের সাথে সাথে শরীরও খারাপ হয়ে যাচ্ছে। আমাকে বাঁচান মা!
মা আবার উনাকে আশীর্বাদ করে বললেন, বাবা এদিকটায় একটু বেশী বেশীই এসো! সেই লোক সেই যে গেলেন, দিন যায়, সপ্তাহ যায়, তাঁর আর খোঁজ নেই।
(২)
কয়েকমাস পর তিনি ফিরলেন, ভগ্ন হৃদয়, চোখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট, সেই সাথে দৃশ্যমান স্বাস্থ্যহানী। মা উনাকে দেখে ভীষন কষ্ট পেলেন।
উনি মাকে বললেন, মা এ জীবন আমি আর রাখবো না। আমি চললুম। আপনার কাছে এসেও কোন ফল পেলাম না।
মা বললেন, বাবা, তুমি কি সত্যি চাও তোমার মনে ভক্তি আসুক?
লোকটা বললেন, আলবৎ।
মা বললেন, বাবা, নিজের মনটাকে কি তুমি বোঝ?
তিনি বললেন, এ কি কথা মা, কেন বুঝবো না?
মা বললেন, বলো তো তোমার মন কি চায়?
তিনি বিন্দুমাত্র দেরী না করে বললেন, ভক্তি চায়!
মা বললেন, এটাই তোমার মনের কথা?
তিনি বললেন, আজ্ঞে হ্যাঁ !
মা বললেন, বাবা তুমি একটু ধ্যান করো তো! শুধু এক ঘন্টা চোখ বন্ধ করে যা খুশী ভাবতে থাকো। ঈশ্বরকে ভাবো, মনে যা আসে তাই নিয়ে ভাবো, কি চাও, কি চাওনা, কি ভালো লাগে, নিজের দোষ, নিজের গুন, সব নিয়ে ভাবো। ঘুম চলে আসলেও দোষ নেই।
লোকটা বললেন, একি বলেন মা, আমি কিভাবে ধ্যান করবো, এই অস্থির মন নিয়ে? আর আমি একঘন্টা কিভাবে বসে থাকবো? মা, আমার দোকানে যে আমি কাউকে বসিয়ে আসি নি, বিক্রি না হলে খাবো কি?
(৩)
মা বললেন, বাবা! এই যে শুধু এই চাই ওই চাই, প্রতি পদক্ষেপে জিততে চাই, এসবই তোমার অস্থিরতার কারন। আমি তোমাকে প্রতিবার আশীর্বাদ করে বলেছিলাম এখানে আসতে, তোমার সময় হয়নি। বাবারে, যা কিছু চাইবে, তার জন্য তো সময় দিতে হবে তাই না, সময় কি দিয়েছো বাবা?
লোকটা লজ্জা পেলো। নিজের জন্য যিনি একটা ঘন্টা সময় দিতে পারেন না, তিনি কিভাবে ধীর স্থির হবেন।
মা বললেন বাবারে আমার কথা তুমি অন্ধের মতো শুনতে পারলেনা, তুমি কি করে আমার ভক্ত হবে? ভক্তি মানেই অন্ধ বিশ্বাস, ভক্তি মানেই ভালোবাসা, ভক্তি মানেই ঈশ্বর! সহজ করে কিছুই হয় না রে পাগল, লেগে থাকতে হয়, জীবনে কত ঢেউ আসবে, তলিয়ে গেলে চলে? এটাইতো খেলা রে!
সব সময় জিততে চাইবি তো একদিন দেখবি আসল জায়গায় হেরে গেছিস। এই যে তুই আমারমার কাছে আসলি এটাও তোর নিজের মনকে ধোকা দিতে, এটা ভক্তি নয়, এটা চালাকি! এক সাথে এত কিছু নিয়ে ভাবিস না! সংসারে মন রেখেও ধ্যান করা যায়! সারাদিনে কত সময় নষ্ট করিস?
(৪)
লোকটা মুখ নিচু করে বসে থাকলেন। মা বললেন, বাবা, কিছু বললে শুনতে হয়, সব নিজের মন মতো চললে হয় না! যা মাঝে মাঝে এখানে এসে নিজের মনকে একটু শান্তি দিস! তোকে আমি জোর করে, ভয় দেখিয়ে ধ্যানে বসাই নি কেন জানিস? তোর নিজের উপলব্ধির জন্য। তোকে আরো আগে ধ্যানে বসালে তুই আরো খারাপ হয়ে আর আমার কাছেই আসতি না। ভক্তি মানেই ভালোবাসা সেটা মনের ব্যাপার এতে জোর চলে না। মনদিয়ে চাইলে আর সেই লক্ষ্যে কাজ করলে কিছুই অধরা থাকে না!
এরপর দীর্ঘদিন সেই লোক ধ্যান করে গেলেন। তার মন স্থির হলো, ক্রোধ প্রশমিত হলো, তিনি তাঁর জীবনে এতটাই উন্নতি করলেন যে এখন মানুষ মন শান্ত করতে উনার পরামর্শ নিতে আসেন!
চট্রগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ