বাঁচবেন নাকি ধুকে ধুকে মরবেন?? সিদ্ধান্ত আপনার।।ডা. ফারহানা সীমা

ধূমপান

বাঁচবেন নাকি ধুকে ধুকে মরবেন?? সিদ্ধান্ত আপনার।

 

ধূমপান মরণ পান।

হাসপাতাল একটা অদ্ভুত জায়গা, যেন মর্ত্যলোক আর পরপারের মাঝামাঝি কোন একটা স্টেশন! এখান থেকে কেউবা সুস্থ হয়ে হাসিমুখে বাড়ি ফেরে, কেউবা সমস্ত বন্ধন ছিঁড়ে চলে যায় পরপারে।

বাবার কাকা অসুস্থ, সম্পর্কে দাদা হন। বয়সে বাবার চাইতে তিন কি চার বছরের বড়। হঠাৎই অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। কী সমাচার কিছুই জানি না। ফোন অসলো লাইফ সাপোর্টে আছেন।

দৌড়ে গেলাম হাসপাতালে। ইমার্জেন্সি পার হয়ে লিফটের চার। উঠতেই বারান্দায় দেখি হাতে মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে পাঁচ সাতজনের জটলা। পরিবারে নতুন অতিথির আগমন, তাই অপারেশন থিয়েটারের সামনেই প্রিয়জনদের মিষ্টি খাইয়ে আনন্দ উদযাপন করছেন তারা।

আর একটু এগিয়ে যেতেই শুনি কান্নার রোল। কেউ হয়তো মারা গেছে, স্বজনদের আর্তনাদে ভারী হয়ে আছে হাসপাতালের চারদেয়াল!

আমি এগুতে থাকি নানান রঙের মানুষ আর তাদের হাসি কান্না দেখতে দেখতে, গন্তব্য আই সি ইউ মানে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট। দাদা ওখানেই আছেন, লাইফ সাপোর্টে। ডাক্তার হবার সুবাদে কিছু সুবিধা পাই, সেজন্য আত্মীয় স্বজন ও আশা করে যেন তাদের বিপদে পাশে থাকি। সব সময় নিজের ব্যস্ততার জন্য সুযোগ হয়ে ওঠে না, তবুও চেষ্টার কমতি করি না।

এখানে পরিচিত ডাক্তার আছেন, উনার কাছে থেকে রোগীর ডিটেইলস জানতে হবে। কিন্তু ঘটনা শোনার পর হতভম্ব হয়ে বসে রইলাম মিনিট খানেক। যা শুনলাম তাতে আর অপেক্ষারতদের কোন আশার বাণী শোনাতে পারবো বলে মনে হয় না।

দাদা বেশ স্বস্থ্যবান মানুষ এবং যথেষ্ট হেলথ কনশাস। আগে প্রচুর বিড়ি সিগারেট খেতেন, বছর খানেক হয় সেটাও ছেড়ে দিয়েছেন একদম। কিন্তু মাস খানেক যাবত নাকি একদম হঠাৎই কথা ভুলে যাচ্ছিলেন, যেমন ডিনার করে উঠে কিছুক্ষণ পরেই নাকি বলছেন খাবার দাও, আমি ত কিছু খাইনি। কিন্তু কেউ তেমন পাত্তা দেয়নি ব্যাপারটায়।

এর কিছুদিন পর থেকেই নাকি হাঁটতে গেলে হঠাৎই পড়ে যাচ্ছিলেন, যেটাকে বলে এটাক্সিয়া। এরপর উনাকে ডাক্তার দেখায় পরিবারের সদস্যরা। ব্রেইনের সিটি স্ক্যান করে ডাক্তার খারাপ কিছু একটা সন্দেহ করেন। আরো ডিটেইলস ইনভেস্টিগেশন করার পর দেখেন ফুসফুসে একটা ক্ষত। এরপর ফুসফুসের বায়পসি করে কনফার্ম হন যে এটা মূলত ফুসফুসের ক্যান্সার যেটা ব্রেইনে মেটাস্টেসিস হয়েছে মানে ব্রেইনে ছড়িয়ে পড়েছে।

কিন্তু পুরো ব্যাপারটাই ঘটেছে প্রায় নীরবে এবং খুব অল্প সময়েই। ফুসফুসের ক্যান্সার জনিত কোন লক্ষণ প্রকাশ পায় নি, বরং রোগী যখন ডাক্তারের কাছে এসেছে তখন রোগটা ছড়িয়ে পড়েছে ব্রেইনে, একদম এডভান্সড স্টেইজ। তখন আর কিছুই করার নেই।

এবং ব্রেইনেও এই ক্যান্সার এত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছিলো যে রোগ নির্ণয়ের পাঁচদিনের মাথায় উনার দৃষ্টিশক্তি চলে যায় এবং শরীরের এক পাশ প্যারালাইজড হয়ে যায়। এবং ছয় দিনের দিন উনি আর নিজ থেকে শ্বাস প্রশ্বাসও নিতে পারছিলেন না। উনাকে কৃত্রিম শ্বাস প্রশ্বাস দিয়ে রাখা হয়েছে।

ফুসফুসের ক্যান্সারের একটা অন্যতম প্রধান কারণ সিগারেট স্মোকিং, এটা বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে। স্মোকারদের মধ্যে কে কতটা স্টিক ডেইলী খান এবং কত দীর্ঘ সময়কাল ব্যাপী উনি স্মোক করছেন তার উপর গবেষণা করে দেখা গেছে, দীর্ঘকাল ব্যাপী বেশী স্টিক গ্রহণকারীদের মধ্যে ফুসফুসের ক্যান্সারের প্রকোপ উল্লেখযোগ্যভাবে বেশী।

যারা সিগাটের খান তারা শুধু নিজেরই ক্ষতি করেন না, ক্ষতি করেন তার চারপাশের মানুষগুলোর ও। যিনি সিগারেট খান তিনি হলেন অ্যাক্টিভ স্মোকার। সিগারেট খাবার সময় তিনি ধোঁয়া নিঃসরণ করেন। মানুষকে বেঁচে থাকতে হলে শ্বাস প্রশ্বাস নিতেই হয়। আর তাই যখন আপনি আমি আমরা যারা সিগারেট খাই না কিন্তু স্মোকারদের আশেপাশে থাকি তারা নিজের অজান্তেই সেই ধোঁয়া শ্বাসের সাথে ফুসফুসে টেনে নেই। আমরা হলাম প্যাসিভ স্মোকার। আমরাও কিন্তু রিস্কে আছি।

এই ভয়াবহ গল্পটা বলার তেমন কোন উদ্দেশ্য নাই, যারা স্মোক করেন তাদের একজনও যদি এই লেখা পড়ে প্রতিজ্ঞা করেন ধূমপান ছেড়ে দেবেন সেখানেই এই লেখার সার্থকতা। নিজে বাঁচুন, চারপাশের মানুষগুলোকে ভালো রাখুন। আপনার অসুস্থতা আপনার পুরো পরিবারকে বিপর্যস্ত করে তুলবে, আপনার সন্তানকে ঠেলে দেবে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে। কেন ভাই, এত কষ্টের উপার্জনের টাকা দিয়ে মৃত্যু কিনে খাবেন? বাঁচবেন নাকি ধুকে ধুকে মরবেন?? সিদ্ধান্ত আপনার।

ধূমপান মরণ পান।

ডা. ফারহানা আফরোজ সীমা

ডা. ফারহানা সীমা

Photo by Jaroslav Devia on Unsplash

Related posts

Leave a Comment