মরেও ” অপমানিত ” হওয়ার লজ্জা যেন আমাদের বয়ে বেড়াতে না হয়।
ফেইসবুকে স্টাটাস দিয়ে যুবকের আত্মহত্যা
মুশফিক মাহবুব নামে ঢাকা ভার্সিটির এক ছাত্র সম্প্রতি ফেইসবুকে একটি স্টাটাস দেওয়ার পর আত্মহত্যা করেন।আত্মহত্যার অনেক মনস্তাত্বিক, সামাজিক, শারীরবৃত্তীয় কারন রয়েছে।
মুশফিকের স্টাটাস থেকে সমাজ বিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানীরা এরকম চরম সিদ্ধান্তের পিছনে ” সমাজতাত্ত্বিক ” ব্যাখ্যাগুলো খুজে পেতে গবেষণা করতে পারেন।
মুশফিকের স্টাটাস এর কিছু অংশ এরকম ঃ “সিস্টেমটাই যেখানে করাপ্টেড সেখানে কথা বলার তোমার ন্যূনতম অধিকার নাই… সময় এসেছে বোঝার যে তোমার উচ্চ কন্ঠ কোন কাজেই আসবে না… আমি বাংলাদেশী হিসেবে স্বাধীনতা চাই.. যদি এর জন্য আমাকে মরতে ও হয়।”
কিন্ত সে উল্টো আত্মহত্যা করে বসলো।
আত্মহত্যার সামাজিক কারন নিয়ে গুরুত্ব পূর্ণ গবেষণা করেছেন এমিলি ডার্কহেইম( Emile Durkheim) .।
তার গবেষনার মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছে আত্মহত্যা সে সমাজে বাড়ে যেখানে সামাজিক সংহতি ও সামাজিক নিয়ন্ত্রণের অভাব থাকে।
তার মতে সামাজিক সংহতি বিনষ্টির কারনে যে আত্মহত্যা তার নাম ” ইগোইস্টিক সুইসাইড “; সমাজে ” সম্মিলিত শৃংখলার ” অভাব হলে যে আত্মহত্যা তার নাম ” এনোমিক সুইসাইড “।
আমাদের সমাজে কি সামাজিক সংহতি বা সামাজিক শৃঙ্খলার অভাব দেখা দিচ্ছে না?
অন্য দিকে প্রখ্যাত মনোবিজ্ঞানী স্যালিগম্যান বিষন্নতা, হতাশা ও সবশেষে আত্মহত্যার পিছনে উল্লেখযোগ্য যোগ্য কারণ হিসেবে ” অর্জিত অসহায়ত্ব ” বা আরো ভালো ভাবে বললে সমাজ “আরোপিত অসহায়ত্ব ” এর কথা উল্লেখ করেন।
এটি এমন এক অবস্থা যেখানে ব্যক্তি এমন এক বেড়াজালে নিজকে আটক মনে করেন যেখান থেকে বের হওয়ার কোন উপায় তার নেই।
বার বার চেষ্টা করে,সংগ্রাম করে সে ব্যর্থ হয়।কোন রকম চেষ্টাই ফলপ্রসূ হয় না।
এক সময় সে বিশ্বাস করে নেয় এই বন্ধন থেকে তার মুক্তির কোন উপায় নেই।তাই সে নিশ্চল,নিশ্চুপ হয়ে যায়।এই যন্ত্রণাময়,বিভীষিকাময় অবস্থাকে সে ” নিয়তির ” নির্মম লিখন বলে মেনে নেয়।
কখনো কোন সুবর্ণ সুযোগ আসলেও তখন সে বা তারা মুক্ত হওয়ার কোন চেষ্টাই করে না।সিস্টেমের কাছে এক ধরনের অসহায় আত্মসমর্পণ করে থাকে।
সেই ঘেরাটোপে আটকে থেকে তারা ক্রমাগত ক্ষোভ, ঘৃনা,হতাশায় জ্বলতে থাকে। মুক্তির একমাত্র পথ তখন মনে হয় আত্মবিনাশ।
এডউইন স্নিডম্যান আত্মহত্যার পূর্বেকার অসহনীয় মানসিক যন্ত্রনার নাম দেন ” সাইকো- এ্যাক”( যেমন মাথার যন্ত্রনার নাম হেডএ্যাক)।
ফ্রয়েড এর মতে যখন কেউ তার বাহ্যিক বা আভ্যন্তরীন কোন বিষয় / বস্তু ” হারিয়ে ” ফেলে তখন তার মধ্যে যে ক্রোধের সৃষ্টি হয় সেটি তার ভেতরে অন্তর্মুখী হয়ে গিয়ে আত্মধ্বংসী রূপ নেয়।সে তখন নিজকে খুন করে ফেলে।
এদিকে কে জেমিসন নিজের আত্মহত্যার চেষ্টার বিবরণ দিতে গিয়ে লিখেন ” এন আনকোয়েট মাইন্ড ” বা ” একটি অশান্ত মন”।
এই যে সাইকোএ্যাক বা মনো-যন্ত্রনা,
অন্তর্মুখী ক্রোধ
বা অশান্ত মন
এর পিছনে সমাজ কতটুকু ভূমিকা রাখে?
মুশফিক লিখেছে আমাদের সমাজ পুরো করাপ্টেড, এখানে পরিবর্তনের কথা বলে কোন লাভ নাই।
সে অসহায়ের মতন লিখেছে এখন বোঝার সময় হয়েছে উচ্চ কন্ঠে প্রতিবাদ করেও কোন লাভ হবে না।সে কি এক ধরনের অর্জিত অসহায়ত্বে ভুগছিল? নাকি তার কোন মানসিক রোগ ছিল?
আরো অনেক কিছু না জেনে এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কিছু বলা ঠিক হবে না।
তবে কারণ যা-ই হোক এভাবে আত্মহত্যা কাপুরুষোচিত কাজ।
একে মহিমান্বিত করে দেখার কোন উপায় নেই। জীবন কখনো কখনো এমন হতে পারে যে আমরা হতাশা, আশাভঙ্গের কালো গহ্বরে নিপতিত হতে পারি। কিন্তু এর জন্য জীবনের হালছেড়ে দিলে হবে না। আমাদের মনে রাখতে হবে ” ফাটল ” না থাকলে ভিতরে ” আলো” প্রবেশের কোন স্হান / সুযোগ থাকে না।
জীবন যখন কঠোর বাধার মুখে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায় তখন সে ভাঙ্গা টুকরো গুলোকে একত্র করে আমরা আরো সবল,অভিজ্ঞ ও সমৃদ্ধ মানুষ হতে পারি।
চ্যালেঞ্জের সময়ে আমরা আমাদের সুপ্ত সম্ভাবনা, সক্ষমতা ও সামর্থ্য প্রকাশ করার সুযোগ পাই।
তাই জীবনের তিক্ততা, ব্যর্থতা থেকে ঘুরে দাড়াবার সামর্থ্য অর্জন করতে হবে
,জীবন জগতের শুভ, মঙ্গলকর দিকটি বেছে নিতে হবে।
আত্মহত্যা পরাজয়ের নাম,আত্ম-অপমানের নাম। মরেও ” অপমানিত ” হওয়ার লজ্জা যেন আমাদের বয়ে বেড়াতে না হয়।
প্রফেসর ডা. মো. তাজুল ইসলাম
অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট
Photo by Fred Mouniguet on Unsplash