পিতামাতাকে দেওয়া সন্তানের ভিন্ন ধরনের উপহার

পিতামাতাকে দেওয়া সন্তানের ভিন্ন ধরনের উপহার

পিতামাতাকে দেওয়া সন্তানের ভিন্ন ধরনের উপহার

আরো একটি স্বপ্ন পূরণের পথে
__________________________

পৃথিবীর প্রতিটি সন্তান ই কমবেশি স্বার্থপর !
সন্তান হিসেবে আমি নিজেও তাই । এটা সত্য। যুগ যুগ ধরেই এমন হয়ে এসেছে। নিজের সন্তানের প্রতি আমরা যতখানি দায়িত্বশীল হই, নিজের আব্বু আম্মুর প্রতি তা হই না ; হতে পারি না………

সন্তানেরা বড় হবার সাথে সাথে বাস্তবতার ডাকেই সম্ভবতঃ নিজের জীবনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কিশোর বয়সে বন্ধু বান্ধব, তরুন বয়সে ভালো লাগার মানব/মানবীতে বেষ্টিত হই আমরা। এরপর স্বামী/ স্ত্রী,সন্তান, কর্মজীবন, নিজ সংসারে আটকা পড়ে যাই আমরা। চক্রাকারে এটাই ঘটে সবার জীবনে। চাইলেও আমরা পারি না বাবা মাকে আগলে রাখতে নিজ জীবনে। ঈদ, পূজাতে তাদের সাথে কাটানো দু’তিনদিন —- এভাবেই কেটে যায় বাকীটা সময়। তারপর একটা সময়ে …….. আব্বু আম্মু’দের সময় চলে আসে পৃথিবী ছেড়ে যাবার……..।
এটাই স্বাভাবিক মানব জীবন চক্র।

অথচ বাবা মায়েরা(কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া, ব্যতিক্রম মা বাবা কেও দেখার দুর্ভাগ্য আমার হয়েছে) তাদের জীবনের সব থেকে শ্রেষ্ঠ সময়টা খরচ করেন সন্তান লালন পালনে। নিজের সুখ, আরাম, ইচ্ছা, শখ, স্বপ্ন বাদ দিয়ে তারা সন্তানের বর্তমান,ভবিষ্যত সাজানোর চেষ্টা করে যান। বিনিময়ে তাদের প্রত্যাশা তেমন কিছুই থাকে না। হয়তো ‘একটু সময়’ ‘একটু মনোযোগ’ এটাই তারা চান। বিশ্বাস করুন, অর্থনৈতিক সাপোর্ট সব মা বাবা কিন্তু প্রত্যাশা করেন না। এমনকি অর্থনৈতিক ভাবে কষ্টে থাকা মা বাবাও সন্তানের কাছ থেকে টাকা পয়সা চান না সব সময়।

একটা মেয়ের গল্প বলব বলে এত ভূমিকা টানলাম।

তথাকথিত ভালো মেয়ের সংগাতে আপনি তাকে ফেলতে পারবেন না। তাকে বরং খারাপ মেয়ে ই বলা যেতে পারে আমাদের সমাজের হিসেবে । তবে ছোটবেলাতে সে কিন্তু ভালো মেয়েই ছিল। তরুনী হবার আগ পর্যন্ত শান্ত,শিষ্ট,আদব লেহাজ সম্পন্ন, আস্তে ধীরে কোকিল স্বরে কথা বলা,জ্বী হুজুর টাইপ সকল প্রকার ট্রেনিং আমাদের সমাজের আর দশটা মেয়ের মত তাকেও দেয়া হয়েছিল পরিবার থেকে। আবার এই পরিবার থেকেই মেয়ে নয় বরং মানুষ হবার ট্রেনিংটাও দেয়া হয়েছিল। সকল প্রকার মৌলিক সুযোগ সুবিধা আদর ভালোবাসা শাসন দিয়ে ব্যালেন্স করে বাবা মা তাকে লালন পালন করেছে। ফলে মেয়েটা নিজের অজান্তেই নিজের ভিতরে ধারন করেছিল স্বচ্ছ স্বাধীন জীবনবোধ। আর এতেই কাল হয়েছিল তার ! মেয়ে মানুষ না হয়ে মানুষ হবার প্রবল আকাঙ্খা তৈরি হয়ে গিয়েছিল ভেতরে। সুদে আসলে তার দায়ও মেটাতে হয়েছিল তাকে। মেয়ে হয়েও আত্মসম্মান বোধ নিয়ে বেঁচে থাকতে চাইবার সাহস করার জন্য।

আমাদের সমাজে এসব আত্মসম্মান টম্মান থাকা
মেয়েদের কে খুব একটা ভালো চোখে দেখা হয় না এখনো। মেয়েটির ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। সমাজ থেকে আসা ঝড়ের দাপট তার পরিবারের উপরেও কম পরেনি। ফলশ্রুতিতে পারিবারিক সম্পর্কগুলোতেও কখনো কখনো মান অভিমান ভুল বোঝাবুঝির শিকার হতে হয়েছে।

একজন মেয়েকে যখন জীবনের শুরুতেই একা হয়ে যেতে হয় তখন সব থেকে বড় সমস্যা কি হয় জানেন ?
মেয়েটির জীবনে বিশ্বাস নামক বস্তুটি হারিয়ে যেতে শুরু করে। সে পারে না আর কাউকে বিশ্বাস করতে। মনে হতে থাকে চারপাশের সবাই তার দিকে ভুরু কুঁচকে তাকাচ্ছে। সবাই তাকে নিয়েই কথা বলছে। না বললেও তার এটা মনে হতে থাকে। আর এভাবেই শুরু হয় তার নিজের ভেতরে গুটিয়ে যাওয়ার।এরপর এক সময়ে পুরোপুরি একা হয়ে যাওয়া। তারপর একাকীত্বকেই ভালোবেসে ফেলা। মনোবিদরা এই মানসিক টানাপোড়েনের যথাযথ ব্যাখা দিতে পারবেন।আমি না।

বর্তমানে মেয়েটি নিজেও একজন মা। সিঙ্গেল মা বলে তার সন্তানের তিন বছর বয়স থেকে সম্পূর্ণ একা সন্তানের বাবার দায়িত্বগুলোও তাকেই পালন করতে হচ্ছে বলে literally মেয়েটিই তার একমাত্র সন্তানের বাবা এবং মা দুটোই। নিজের সন্তানের মা বাবা দু জনের ভূমিকা পালন করতে যেয়ে মেয়েটি প্রতি নিয়ত অনুভব করতে পারে তার বাবা মা কতখানি যত্ন করে তাকে তৈরি করেছিল পৃথিবীর জন্য। এতখানি যত্ন করে তৈরি করা সন্তানকে যখন জীবনে হেরে যেতে দেখছিলেন, ডাক্তারী পড়া মেধাবী নিজ সন্তানকে প্রতি নিয়ত অপমানিত হতে দেখছিলেন , জীবন শুরু করার আগেই একটা সম্ভাবনাময় স্বপ্নাতুর সন্তানের
জীবনটাকে ধ্বংস হয়ে যেতে দেখছিলেন …………
না জানি কতটা কষ্ট তাদের বুকের ভেতরেও হচ্ছিল ঐসব বিভৎস দিনগুলোতে।

মা ছেলের ছোট্ট টুনটুনি সংসারের অর্থনৈতিক চাকা সচল রাখা থেকে শুরু করে দরকার মতো টয়লেট ক্লিন, রান্না, বাজার করা, সামাজিক দায়বদ্ধতা মেটানো থেকে এই আজীব সমাজের অদ্ভূত অসুস্থ কৌতুহল থেকে সন্তানকে সেইফ জোনে রেখে একজন আত্মবিশ্বাসী পূর্নাঙ্গ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা থেকে
ছেলের সাথে খেলাধুলা, আড্ডা মারা, শাসন আদর সোহাগ, নামাজ পড়াসহ যাবতীয় সব কাজই করতে হয় এক হাতে। এর পাশাপাশি 24/7 হিসেবে একজন আবাসিক চিকিৎসক হিসেবে কাজ করছে বলে যথেষ্ট দায়িত্বশীল ভাবে কর্মক্ষেত্রে সচল থাকতে হয়। সেই সাথে নিজের স্বপ্ন পূরণের ব্রত নিয়েছে বলে সমান তালে লেখালেখিটাও রোজকার রুটিনে অনেকটা জায়গা দখল করে রেখেছে মেয়েটার।
অনেক কিছু না হলেও টুকটাক কাজে চব্বিশ ঘন্টা কখন যে কেটে যায় টেরই পায় না মধ্য ত্রিশ ছোঁয়া নারীটি। আব্বু আম্মুর সাথে তার যোগাযোগ ফোনেই চলে আজকাল।

জীবনে যেহেতু ups and downs এর ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে মেয়েটিকে এবং একটা সময়ে কারো কথা চিন্তা না করে শুধুমাত্র নিজের জন্য কিছু শক্ত সিদ্ধান্ত মেয়েটিকে নিতেই হয়েছিল সেহেতু অনেকের সাথেই দ্বিমত ঘটেছিল। হয়তো মেয়েটি ই তার পয়েন্ট অফ ভিউ তাদেরকে বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছিল। কিন্তু মেয়েটি জানত সে অন্যায় করছে না। এক সময়ে সবার ভুল ভাঙবে ই। মেয়েটি প্রবলভাবে বিশ্বাস করতো—– যখন সে ভালো থাকবে, নিজেই নিজের জীবনের দায়িত্ব নিয়ে ফেলবে, বাবা মা সহ আশেপাশের সকল আপন মানুষগুলোকে বোঝাতে এবং দেখাতে সক্ষম হবে “জীবন নামক রেসের একটা পরীক্ষাতে ফেল করে গেলেও আমি তোমাদের বোঝা হচ্ছি না , আমি ভালো আছি নিজের মতো করে নিজের জীবনে” ঠিক সেদিন আপন মানুষগুলোর ভুলগুলো ভেঙে যাবে। তারা হয়তো খানিকটা গর্ব বোধও করে ফেলতে পারে তাদের মেয়েটি এত এততত অপমানের , কলঙ্কের দায় মাথায় নিয়েও মরে না যেয়ে বরং একজন দায়িত্বশীল মানুষ হিসেবে মাথা উঁচু করে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে আছে বলে, হয়তো।

মেয়েটা সমুদ্র প্রচন্ড ভালোবাসে। নিঃশব্দ চারপাশে সমুদ্রের গর্জন শুনতে তার কাছে অপার্থিব সুখ সুখ লাগে। জীবনে এখন পর্যন্ত বহুবার সমুদ্রের তীরে দাঁড়ানোর সুযোগ সে পেয়েছে।খুব ছোটবেলায় মা বাবার হাত ধরে ফ্রক পরা বালিকাটির সমুদ্র দর্শনের শুরু। এরপর জীবনের সব ভালোবাসা আর বিশ্বাস এক লহমায় দিয়ে ফেলা মানুষটির হাতে হাত রেখে নীল সমুদ্রের তীরে নীল রঙের শাড়ি গায়ে জড়িয়ে সমুদ্রের জলে ভালোবাসা কে খোঁজা।
অতঃপর শূণ্য হওয়া …….
শূণ্যতাকে আঁকড়ে ধরেই পূর্ণ হবার পথ খুঁজে নিয়ে পথ চলা। এর মাঝে আরো বহুবার সমুদ্রের তীরে দাঁড়িয়েছে মেয়েটি কখনোবা একা, কখনোবা সন্তানের ছোট্ট হাত মুঠোয় পুরে। স্বপ্ন দেখেছে প্রতিবারই নতুন করে জীবনে ফিরে আসার।

জীবনে বহুবার হোঁচট খেয়েও মেয়েটি বিশ্বাস করে, ভালোবাসা দিলে বিনিময়ে ভালোবাসা মেলে । প্রতিটা কাজের ইনপুট দিলে আউটপুট অবশ্যই ঘটে। তাইতো মা বাবাকে একটু আনন্দ দিবে বলে তাদের বিবাহ বার্ষিকীতে তাদেরকে সাথে নিয়ে সমুদ্র দর্শনের স্বপ্ন বুনেছিল মেয়েটি। তার প্ল্যানে আছে আব্বু আম্মু কে সারপ্রাইজ দিবে—- দেশের অন্যতম হানিমুন স্যুটে এ রোমান্টিক সময় কাটানোর বিষয়টিও। যে দুটো মানুষের জন্য মেয়েটির পৃথিবী দেখা, এ মানব জন্ম– তাদেরকে এতটুকু চমকে দেবার উপলক্ষ্য মেয়েটি হেলায় হারাবে না কিছুতেই।
সাথে থাকবে তার আত্মজ।

একদিন যখন তার ছোট্ট পুত্রটি অনেক অনেক বড় হবে, সেদিন যখন মেয়েটি একাকী বৃদ্ধার জীবনে উপনীত হবে (যদি বেঁচে থাকে ততদিন আরকি) তাহলে তার সন্তানও তার ভীষন ব্যস্ত জীবন থেকে খানিকটা সময় বের করে মা’কে সারপ্রাইজ দেবার প্ল্যান করবে। মা কে নিয়ে উড়াল দিবে কোন এক সমুদ্র সৈকতে । সেদিন হয়তো মা ছেলের এই ছোট্ট পরিবারটি আর ছোট থাকবে না। টুকটুকে বুদ্ধিমতী একটা বৌমা আর নাতি নাতনি বেষ্টিত বিশাল একটা পরিবার হয়ে যাবে নিশ্চিত।হয়তো সেদিন মেয়েটির আব্বু আম্মুও তাদের সাথে থাকতে পারে ।
স্বপ্ন দেখে স্বপ্নবাজ মেয়েটি………

.
পিতামাতাকে দেওয়া সন্তানের ভিন্ন ধরনের উপহার
#মিম্ মি

Photo by Ghost Presenter on Unsplash

Related posts

Leave a Comment