ফেইসবুকের সুখ অসুখ

ফেইসবুকের সুখ অসুখ

ফেইসবুকের সুখ অসুখ

 

প্রিয় বন্ধুর মন খারাপ। কারণ জিজ্ঞেস করতেই বলে “জানিনা”। বেশী ঘাটাই না আমি, জানি মন খারাপের সময় পাশে আপন কাউকে লাগে, যে ক্ষতে মলম না দিক অন্তত লবন দিবে না। বললাম, “তোরে দেখলে বোঝা যায় না”। ও হেসে বলে, “ফেইসবুক তো চির সুখের জায়গা! এখানে কোন অসুখ নাই।”
বললাম, “কী জানি বাবা,বুঝিনা!”

বুঝিনা বললেও আমি বুঝি! হয়তো একটু বেশীই বুঝি! ছোটবেলা থেকেই বেশী বোঝা আমার রোগ, অন্তত সবাই তাই বলে!

হুম, আসলেই ফেইসবুক চির সুখের জায়গা। এখানে মানুষ যত্ন করে কষ্ট লুকিয়ে তারচাইতে বেশী যত্ন করে ঠোঁটের কোনে হাসি ঝুলিয়ে রাখে; যাতে এর পেছনের বেদনাটুকু কেউ ঘুণাক্ষরেও জানতে পারে না। দুটো ঘটনা বলবো আজ, আমার খুব কাছ থেকে দেখা।

ঘটনা ১:

ঝুমু (ছদ্মনাম), ছোট বোনের বান্ধবী, অপরূপা মিষ্টি একটা মেয়ে। স্বামী আর এক সন্তান নিয়ে ভীষণ সুখের একটা সংসার। অন্তত দু’দিন আগ পর্যন্ত আমি তাই জানতাম। ওদের উথাল পাথাল প্রেম দেখলে আমার খুব ঈর্ষা হতো। আজ সিংঙ্গাপুর তো কাল বালি……..ফটোগ্রাফিক রোমান্টিক কাপল ফটোতে ফেইসবুক টইটম্বুর! আমার উনাকে প্রায়ই ওসব দেখিয়ে গাল ফুলিয়ে বলতাম, “তুমি তো বাড়ির পাশে মাঠেও একটু নিয়ে যাও না! জড়িয়ে ধরে একটা ছবি হুহ্, তুলছো কোনদিন আমার সাথে? কপাল আমার!”

আমার এইসব অভিযোগের কোন পাত্তাই নাই উনার কাছে। দু’দিন আগে ইনবক্সে ঝুমুর নক, একটা ছবি পাঠিয়েছিল, লিখেছে “কী ওষুধ খেলে ব্যথা কমবে আপু?”। ধবধবা ফর্সা বাহুতে জমাট রক্তের দাগ, লম্বালম্বি জায়গাটা শক্ত কিছু দিয়ে আঘাত করেছে কেউ। এইসব সিরিয়াস ইস্যুতে ইনবক্সে টিপিয়ে টিপিয়ে চিকিৎসা দেবার ধৈর্য্য আমার নাই, তাও আবার কাছের কেউকে।

ফোন দিলাম, “কী হইসে? কীভাবে ব্যথা পাইছিস?” হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো মেয়েটা, “ও মেরেছে আপু।” অবাক আমি কথা বলতে পারিনা এক মুহূর্ত, “কেন?”

ঝুমু কান্না থামায়, “প্রতিদিনই তো মারে, মাতাল হয়ে বাসায় ফেরে। তোমরা তো দেখো আমি সুখের সমুদ্রে হাবুডুবু খাই। কত সুখ তা যদি জানতা! বিদেশে ঘুরতে নিয়ে যায়, কত ছবি তো দেখো, এই সেদিনও তো তুমি একটাতে কমেন্ট করলা, বালির ছবিতে। হোটেলে দুটো রুম থাকে আপু। একটাতে আমি আর বাবু কাঁদি দিনরাত, অন্যটাতে ও অন্য মেয়ে নিয়ে ঘুমায়। আমার সামনে দিয়েই নিয়ে যায়, আমি না পারি কিছু করতে না পারি সহ্য করতে।” এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে থামে ও।

কী একটা চিনচিনে ব্যথা আমার বুকে বাজে, বলি “আছিস কেন এই নরকে? লেখাপড়া জানিস, ছেলেটাকে নিয়ে চলে যা।” ও বলে, “অনেকবারচেষ্টা করেছি, পারিনি। ওর হাত অনেক লম্বা, ও আমাকে ঠিক খুঁজে বের করবে। আমার বাপ নাই মা নাই, এই পৃথিবীতে তো ছেলেটা ছাড়া আমার কেউ নাই। ও বলে, আমাকে মেরে ফেললেও নাকি ওর কিছু হবে না।”

ঝুমু কাঁদে……..ওর কান্নার শব্দে আমার বোধশক্তি অচেতন হয়ে যায়। আমি ওকে সান্ত্বনা দিতে পারি না, ফোনের ওপাশে থাকা কষ্টে কুঁকড়ে যাওয়া একটা এতিম মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরতে পারি না……আহা কষ্ট! ফেইসবুকের এই মেকি আলো ঝলমলে আকর্ণ বিস্তৃত ঠুনকো হাসিকে আমার কঠোর চপোটাঘাত করতে ইচ্ছে করে, অক্ষম আমি……পারিনা কিছুই!

ঘটনা ২:

শম্পা (ছদ্মনাম), পেশায় ডাক্তার। এফসিপিএস কোর্সে ট্রেনিং করা সূত্রে পরিচয় আমার সাথে, পরে আমরা দু’জন খুব ভালো বন্ধু হয়ে যাই। আমার বড় ছেলের বয়স যখন ছয় তখন মাত্র ও বিয়ে করে। বিয়ের বয়স দু’বছর চলছে। ওদের বিয়েতেই শেষবার দেখা হয়েছিলো, ওর বর চিটাগাং মেডিক্যালে আছে। দেখা না হলেও ফেইসবুকের সুবাদে ওদের সব সুখী মুহূর্তগুলোর সাক্ষী হতে পারি, শুধু সুখী বললে ভুল হবে; এক্সট্রাঅর্ডিনারি সুখী! যাদের সুখ দেখলে তিনবেলা নিয়ম করে হিংসা করতে ইচ্ছে হতো আমার, ও তাদেরই একজন। হতো বলছি, এখন হয় না। কেন হয় না সে কথায় যাচ্ছি ধীরে ধীরে। ইনবক্সে ওর সাথে কথা হয় মাঝেমাঝে, হাই হ্যালো টাইপের আর বিবাহিত জীবনের দু’একটা এডাল্ট কথাবার্তা, খুনসুটি। হঠাৎ একদিন আবার ইনবক্সে নক। সন্ধ্যা তখন, কথা বলতে বলতে রাত পেরিয়ে মধ্যরাত হয়ে যায়, অথচ আমাদের হুশ হয় না। কী এক অদ্ভুত আবহাওয়া ছিল সেদিন, শম্পার বর একটা কনফারেন্সে দেশের বাইরে। এজন্যই বোধহয় ও সব কথার ঝাঁপি নিয়ে আমার দুয়ারে হানা দিয়েছিল, যার সারাংশ হলো, এই অভিশাপের জীবন ও আর বইতে পারছে না। ওর বর একটা সেক্সুয়ালী পার্ভাটেড মানুষ, রাত হলেই যে অন্য মানুষ হয়ে যায়। হেন অত্যাচার নাই মেয়েটা সহ্য করে না…………এসব শুনলে মাথা ঝিম মেরে থাকে, কষ্টের বোধগুলোও যেন নির্বোধ হয়ে যায়!

ফেইসবুকের পাতায় পাতায় অনেক সুখী মানুষের ভিড়ে কিছু মানুষ গোপনে এমন নিদারুণ কষ্ট বয়ে বেড়ায়, যার খবর কেউ জানেনা।

ডা. ফারহানা আফরোজ সীমা

ডা. ফারহানা আফরোজ সীমা

Photo by Tom Holmes on Unsplash

Related posts

Leave a Comment