রোজা এবং একটি বোর্ডিং স্কুল ( পর্ব ২)

রোজা এবং একটি বোর্ডিং স্কুল ( পর্ব ২)
__________________________________

(প্রথম পর্ব পড়তে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন)

(দ্বিতীয় পর্ব)

আমার প্রাণের শহর পদ্মা পাড়ের ছোট শান্ত নিরিবিলে ফরিদপুরে শুরু হয়েছিল আমার জীবনে রোজার মাসের। আব্বু আম্মু আর বোনদেরসহ আমাদের হৈচৈ কলকালকিতে মুখরিত পুরানো দিনের ঐতিহ্যের ধারক বিশাল বাড়ির প্রতিটি ইন্চিতে মায়া মমতার বন্ধনে,আশেপাশে চাচা ফুপু এবং এক রাজ্যের এলাকাবাসী, না না……পুরো শহরটাই তো ছিল আমার পরিচিত আত্মার খুব কাছের মানুষগুলোর সাথে; অসাধারণ কান্না পাবার মতো সুন্দর এক একটা রোজার মাস জীবনে কাটিয়েছি মেডিকেল কলেজে আসার আগ পর্যন্ত।

নব্বই দশকের শেষের দিক জুড়ে আমার মেয়েবেলা।

সেসময় রিক্সায় করে মাইকিং হতো— “ওঠেন ওঠেন ভাইসাবরা সেহেরী খান, সেহেরী খান। আর মাত্র বাকী পনেরো মিনিট ……উঠে পড়ুন ঝটপট.” সাথে চলতো ইসলামিক গান। আমি আর আমার বোনেরা মিলে বারান্দা থেকে দেখতাম রিক্সায় করে মাইকিং করা ছেলেগুলোকে।মনে হতো ইস কি মজা ওদের। শীতের সময়ে হুডি চাদরে নিজেদেরকে মুড়ে ওরা এই কাজ করত। শেষ রোজাতে একটু একটু মায়া হতো ছেলেগুলোর জন্য। এক বছর অপেক্ষা করতে হবে আবার—-” ওঠেন ওঠেন ভাইসাবরা” সেহেরির খান শুনতে। ঠিক মনে পড়ে না কত বছর বয়স থেকে সেহেরির এই আহ্বান আমার রক্তে মিশে গেছে। এখন যেখানে থাকি তা হচ্ছে রীতিমতো গহীন বন বাদাড়। প্রথম সেহেরীতে কান পেতে ছিলাম মাইকিং শুনব বলে। মনে হয় আজন্ম লালিত এই কাজটা প্রতি রোজার রাতেই করে যেতে হবে আমায়।

আমাদের ছেলেবেলাতে ঘরে তৈরি ইফতারের রেওয়াজ ছিল। মনে পড়ে না তখন ইফতারির দোকান বলে কোন কিছু ছিল কিনা ফরিদপুর শহরে। আজও মনে আছে শেষ রাতে সেহেরির সময়ে আম্মু উঠতে সবার আগে। তরকারি রাতে রান্না করে রাখা হলেও ভাত হতো শেষ রাতে রান্না।গরম ভাত নাহলে যেন হতো না। তরকারি দিয়ে খেলেও দুধ কলা দিয়ে ভাত না খেলে সেহেরি যেন অপূর্ণ থেকে যেত। সেহেরির দোয়া আব্বু সাথে সাথে পড়ে নিতাম আমরা। তখন থেকেই অপেক্ষা শুরু হতো ইফতারির। বাসার কাজে সাহায্য করা মেয়েদেরকে বলত ছোলা আর ডান ভিজিয়ে রাখতে। সকালে ঘুম থেকে উঠে নামাজ কোরান পড়তাম আমরা বোনেরা।একটু যখন বেশি ছোট ছিলাম তখন তো দিনে দু তিনটা রোজা করে ফেলতাম। হিহি ! বড়রা বলতো দুপুরে খেলে একটা রোজা হয়ে যাবে আমাদের। আবার ইফতার করলে দুটো রোজা।

ছোটবেলাতে রোজা রাখার উপর কঠিন নিষেধাজ্ঞা ছিল। মানে প্রথম আর শেষ রোজা রোজা করলেই নাকি পুরো রোজার মাস কে বেঁধে ফেলা হয়। আর একটু বড় হলে বলা হলো সাতাশে রোজাটা করতে পারব আমরা।

দুপুর গড়ালেই কেমন একটা উৎসব উৎসব ঘ্রান বের হতো চারপাশ থেকে। আম্মুসহ আশেপাশের বাসার সব চাচি,ফুপু, আন্টিরা হেঁসেলে ঢুকে যেতেন। আমার মা’র হাতের রান্না খুবই মজাদার। ইফতারে আইটেমগুলো জাষ্ট অমৃত হয় আম্মুর হাতে। সারাদিন রোজা করে আমাদের সবার জন্য ইফতার বানাত আম্মু, এখনো বানায়। চিড়ে ভিজিয়ে রাখা হতো ঘন সর পড়া দুধ দিয়ে, এর উপরে চাক চাক করে কলা কেটে ছড়িয়ে দেয়া হতো। সাথে কয়েক টুকরো বাতাসা। কি যে মজার একটা খাবার। হরেক রকম বাহারি সিজনাল ফল থাকতো। তবে খেজুর অবশ্যই থাকতো। সরবত হতো কয়েক রকম।এছাড়া পেয়াজু,বেগুনী,ছোলা আর মরিচ ভাজা অবশ্যই থাকতো সব সময় ইফতারে। পিঠাও থাকতো কখনো কখনো।আমাদের বাসাতে আরেকটা ট্রাডিশন ছিল– রোজ ই স্পেশাল ডিনার আইটেম। কোনদিন হতো পরোটা মাংস,কোনদিন চালের রুটি,ছিদ রুটি বলে এক ধরনের পিঠা বানানো হয় আমাদের ফরিদপুরে। ছোট ছোট ছিদ্রযুক্ত রুমাল সেইপের পিঠা।মাংস দিয়ে খেতে হয়।কি যত্ন নিয়ে যে আম্মু তৈরি করতো এসব।এছাড়া বিরিয়ানি,খিচুড়ি ,পোলাও তো হতোই।

আরো একটা ট্রাডিশন ছিল রোজার সময়ে। আত্মীয় স্বজন পাড়া প্রতিবেশীদের বাসায় ইফতার পাঠানো। তারাও পাঠাত আমাদের বাসায়। আমাদের বাসাতে কয়েকজন হিন্দু ভাড়াটে থাকতেন, প্রতিবেশী হিসেবে আরো কয়েক ঘর হিন্দু কাকা কাকী, আমার অংকের শিক্ষক ছিলেন।তাদের বাসাতেও ইফতার পাঠানো হতো।ওনারাও সাদরে গ্রহণ করত তা। কি যে
আনন্দময় ছিল সবাই মিলে মিশে কাটানো ছেলেবেলার সেই সময়গুলো।

সত্যি বলতে কি এখন মনে হয় ঐগুলো হয়তো বাড়াবাড়ি ছিল। কিন্তু ঐ যে বললাম ট্রাডিশন। হয়ে এসেছে বছরের পর বছর ধরে। আরো একটা ট্রাডিশন ছিল রোজার সময়ে আমাদের বাড়িতে। ইফতার সব সময় করা হতো আব্বু আম্মুর বেড রুমে বড় চাদর ফ্লোরে বিছিয়ে সবাই মিলে একসাথে বসে। আব্বু আম্মু বোনেরা সবাই আর আম্মুকে কাজে সাহায্যকারীরা। খুব আনন্দ হতো এভাবে খেতে। বছরের আর কোন সময়ে ডাইনিং টেবিল ছাড়া খাওয়া একদম এলাও ছিল না আমাদের বাড়িতে। আমার মা খুব পরিপাটি স্বভাবের। আমাদের বাসার সবকিছু একেবারে নিখুঁত করে সাজানো। খানিকটা ছবির মতো। ছোটবেলা থেকে আমরাও এতে অভ্যস্ত। ঘর বাড়ি এলোমেলো করি না আমরা।

ইফতারিতে বসে আব্বু মোনাজাত ধরত আমাদের সবাইকে সাথে নিয়ে। অদ্ভুত ভালো লাগায় মন ভরে যেত তখন। আমাদের এলাকার মসজিদটি একেবারে আমাদের বিল্ডিং ঘেঁষা। খতম তারাবী হতো সেখানে। এলাকার সব মুসুল্লী দল বেঁধে যেতেন মসজিদে। আব্বু কখনো তারাবী পড়া বাদ দিত না। বাসায় কেন পড়ে না তারাবী এই প্রশ্ন করে জেনেছিলাম যে কোরান খতম দেয়া হয় তারাবী নামাজের সময়ে। তাই তারাবী বাদ দেয়া সম্ভব না। তারাবী নামাজের সময়ে আমাদের পুরো এলাকাটা না অদ্ভুত নিরাবতায় ছেঁয়ে যেত। সুনসান পিনপতন নীরবতা যাকে বলে। সাধারনত সাতাশে রোজাতেই খতম তারাবী হয়ে যেত আমাদের মসজিদে। ইদ ইদ আনন্দ আমাদের শুরু হয়ে যেত। সাতাশে রোজাতে হাতে মেহেদী পড়তাম আমরা দলবেঁধে।

পেছনে ফিরে দেখার অদ্ভুত এক অভ্যাস আছে আমার। সিনেমাতে যেমন দেখায় সেরকম চোখ বুঁজে আমি ঘুরে আসি আমার ছেলেবেলা থেকে যখন মন চায়। সব সময় যে পারি তা না। খুব করে মনোযোগ দিয়ে একটা বিন্দুতে একনিষ্ঠ হতে হয় আমাকে। তারপর কয়েক মিনিটের অতীত পরিভ্রমণ করি ।যখন চোখ খুলি টপ টপ করে দুচোখ গড়িয়ে জল ঝরে গাল বেয়ে।

আমাদের এখানে বোর্ডিং এ থাকা বাচ্চাগুলো একদিন আমার মতো বয়সে পৌঁছুবে। ওদের মধ্যে কারো হয়তো ইচ্ছে হবে আমার মতো করে অতীত ভ্রমণের। ওদের রোজার সময়ে সেহেরির ফ্লাশব্যাকে ওরা দেখবে সিনিয়র, জুনিয়র, বন্ধু, স্যার আর মিস’দের সাথে ডর্মের ডাইনিং হলে সারিবদ্ধ ভাবে বসে সেহেরির করছে। ক্লাস থ্রি থেকেই ওরা এক একজন হয়ে উঠছে নিজ নিজ জীবনের দায়িত্ব নেয়া এক একজন পূর্নাঙ্গ মানুষ। আমার বা আমাদের মত সহজ সরল চিন্তামুক্ত মা বাবা ভাই বোন পাড়া প্রতিবেশী আত্মীয় স্বজন জড়ানো শৈশব টা সম্ভবতঃ ওদের হবে না। হয়তো এই পরিবর্তনটুকু সময়েরই দাবী !

(চলবে)

রোজা এবং একটি বোর্ডিং স্কুল (পর্ব ২)

মিম্ মি

Photo by Samuel Zeller on Unsplash

Related posts

2 Thoughts to “রোজা এবং একটি বোর্ডিং স্কুল ( পর্ব ২)”

  1. Good man! Behold is an important offering for you. http://bit.ly/2rCcwtd

Leave a Comment