রোজা এবং একটি বোর্ডিং স্কুল (পর্ব ১)
_________________________________
(প্রথম পর্ব)
পাপবোধে কুঁকড়ে যাচ্ছি। মরে যাই যাই টাইপ, ভীষন রকম ফ্রাসট্রেশনে আর ডিপ্রেশনে ভুগছি।
মনটা অদ্ভুত ভাবে তার কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলেছে যেন। আজ তিনদিন হলো কিছু লিখতে পারছি না।
একটা লাইনও না ! অথচ লেখালেখি হচ্ছে বর্তমানে আমার একমাত্র বন্ধু। গত তিন বছরে যা যা আমার বলতে ইচ্ছে করে লিখেই বলে ফেলছি। এমনকি জীবনের স্বপ্নগুলোও লিখে লিখেই ছুঁয়ে দেখার পাগলামি করছি। কি যে আনন্দ এতে….. হেরে যাবার অথবা না পাবার বেদনা নেই এই বিচিত্র লেখালেখি খেলাতে।
আমি ফেসবুকটা ব্যবহারই করি লেখালেখির প্লাটফর্ম হিসেবে। না না নাক সিটকাবেন না প্লিজ। আপনাদের মধ্যে অনেকেই ফেবু ব্যবহার করেন ছবি আপলোড করতে , কেউবা মোটিভেশন দিতে, শোঅফ করতে,
অনেকেই প্রেম করার জন্য, প্রডাক্ট প্রমোট করতে , যোগাযোগ রক্ষা করতে । কত শত ব্যবহার যে ফেবুর।
আমি নাহয় লেখালেখিই করলাম।
কেন একটা লাইনও লিখতে পারছি না খুঁজতে যেয়ে আবিষ্কার করলাম ঘটনাটা—–
কর্মসূত্রে আমি এখন আছি বাংলাদেশের প্রথম International Baccalaureate সিস্টেমের বোর্ডিং স্কুলের ক্যাম্পাসে আবাসিক চিকিৎসক হিসেবে। বাংলাদেশে হলেও এর কার্যকারিতা আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী পরিচালিত। তাই আমার কাছে সব কিছুই নতুন এখানকার।
এবারের রোজাই এখানে আমার প্রথম রমজান মাস।
আমি নিজেও জানতাম না এমন মন কেমন করা একটা ফেইজের ভেতর দিয়ে আমাকে যেতে হবে কখনো।
প্রথম সেহেরীতে রাত ঠিক পৌনে তিনটিতে উঠে পড়লাম এলার্ম বাজার সাথে সাথে । সেহেরীতে ডাইনিং এ ডিউটি আছে আমার রাত তিনটা থেকে। আমাদের এখানে পুরো ক্যাম্পাসের সব স্টুডেন্ট, ফ্যাকাল্টি মেম্বার, স্টাফ সবাই একসাথে ইফতার আর সেহেরির করে ডর্ম ওয়ানের বিশাল ডাইনিং এ। এটাই এখনকার নিয়ম। প্রথম দিন(রাত) বলে দারুন এক্সসাইটেড হয়ে আহুকে তুলে পাঞ্জাবী পড়িয়ে মা ছেলে কোয়ার্টার থেকে ছুটলাম ডাইনিং হলে। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে সাথে পেয়ে গেলাম আরো কলিগদের এবং তাদের পরিবারকে।
গার্লস ডর্মের সামনে এসে দেখলাম আমাদের মেয়ে বাচ্চারা সব নেমে এসেছে ডর্ম সুপার ম্যামের সাথে মাথায় ওড়না স্কার্ফ জড়িয়ে। সব বাচ্চাগুলোকে একদম পরী বাচ্চা লাগছিল। ঠিক তিনটাতে ডাইনিং হলে এলার্ম বেজে উঠলে সবাই সিরিয়ালে দাঁড়িয়ে গেলাম আমরা খাবার নেবার জন্য। আমাদের এখানে ব্যুফে স্টাইলে মিল সার্ভ হয়। তুমি প্রিন্সিপাল হও কিংবা ডাক্তার নো ইস্যু যদি স্টুডেন্ট আমার আগে এসে লাইনে দাঁড়ায় ও আগে পাবে ডিস। আমার কাছে খুব দারুন লাগে এখানকার এই বিভাজনহীন নিয়মকানুনগুলো। তো খাবার নিয়ে সবাই বসে গেছে যার যার টেবিলে।
সাধারণত অফিস ডে গুলোতে আমি আমার ছেলের সাথে এক টেবিলে খেতে বসি না। কলিগদের সাথে বসি। তবে আজ প্রথম সেহেরী ছিল বলে বাচ্চাটার সাথেই বসলাম।আমাদের এখানে চেয়ার টেবিলগুলো ফিক্সড সেটাপের। এক একটা টেবিলে চারজন করে বসতে পারে। আমি আর আহু বসার পর আমাদের সামনের চেয়ারে এসে বসল অর্ক আর ইভান(ছদ্মনাম)। এরা দুজন আমাদের এখানকার সব থেকে জুনিয়র বোর্ডার। বাচ্চা দুটো আমার আহুর থেকেও ছোট।
খেতে শুরু করার পরে হঠাৎ কেন যেন অন্য টেবিলগুলোর দিকে একটু তাকালাম। আর সাথে সাথে ছ্যাঁত করে উঠলো আমার বুকের ভেতরটা। অসংখ্য দেবশিশু বসে সেহেরী করছে একসাথে। আমার পাশেই আমার আহ্ নাফসহ অর্ক ইভান। হঠাৎ করে চোখ ঝাপসা হয়ে এলো আমার। নিজের ছেলেবেলাতে ওদের এই বয়সে আমার কাটানো রোজার সময়ের সেহেরির কথা মনে পড়ে গেল।আব্বু আম্মু বোনেরা সবাই মিলে একসাথে বসে শেষ রাতে সেহেরির সেই সব অপার্থিব সময়গুলো ফ্ল্যাশব্যাক হতে লাগলো মানসপটে।
আমার কর্মস্হলের বাচ্চাগুলোর জীবন এক একটা উপন্যাস …….. ওরা আমাদের সমাজের উঁচু তলার পরিবার থেকে আসা। শিক্ষা, অর্থ কোন কিছুর অভাব নেই এদের পরিবারের। গত সাত মাসে যতটুকু বুঝেছি অধিকাংশেরই বাবা মা শুধু সময়ের অভাবে সন্তানকে বোর্ডিং এ পাঠানো। কে দেখবে বাসাতে ? নিরাপত্তাসহ বাবা মায়ের দাম্পত্য জীবনের আরো কিছু জটিল সমীকরণের হিসেব মেলাতেই বাচ্চাগুলোর এই অত্যন্ত দামী এবং আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষায় শিক্ষিত করার প্রয়াস পিতা মাতার।
আমার সৃষ্টিকর্তা কে আমি প্রচন্ড ভালোবাসি।
না এজন্য না যে তিনি আমাকে সব সময় তার ব্লেসিং দিচ্ছেন বলেন। বরং এজন্য যে তিনি আমার জীবনটাকে অকল্পনীয় বৈচিত্র্যময় করে সৃষ্টি করেছেন বলে। গল্প এবং স্বপ্নের থেকেও মোহনীয় এবং রোমাঞ্চকর করে এক একটা পথ পাড়ি দিতে হয়েছে এখন পর্যন্ত আমাকে জীবনে । আমার জীবনের বাঁকে বাঁকে এত বৈচিত্র্য যা যেকোন রহস্য উপন্যাসকে হার মানায় শিউর।
জীবন একটাই …… এই এক জীবনে আজকে পর্যন্ত আমি যতখানি জীবনের প্রতিটি মুহুর্তকে অনুভব করে যাপন করে ফেলেছি বহু চল্লিশ, পঞ্চাশ, ষাট ঊর্ধ মানুষ তা করতে পারেননি । সত্যি ই !
আমার আশেপাশে আমার সমবয়সী নারীদের মতো গড়পড়তা একটা জীবন তৈরি করে দেননি বলে আমি কৃতজ্ঞ আমার স্রষ্টার উপর। আমার নিজেকেই আমার পথ তৈরি করে নিতে হয়, হয়েছে। অবশ্য জন্মসূত্র অসাধারণ একটা পরিবার দেবার জন্যও ধন্যবাদ সৃষ্টিকর্তাকে। যে পরিবারটি আমার শক্ত মজবুত মানসিকতার ভিত্তিটা তৈরি করে দিয়েছিল বালিকাবেলাতেই।
অবশ্য প্রথম প্রথম যে আমার রাগ অভিমান হতো না তা কিন্তু নয়।ভীষন অভিমান হতো। চিৎকার চেঁচামেচি করে কত যে কেঁদেছি— কেন এত বিশ্রী কষ্টকর একটা জীবন আমার হবে ? কেন ? কি লাভ হলো ‘ভালো মেয়ে’ হতে চাইবার হাস্যকর সব চর্চা করে ছোটবেলা থেকে ? ইত্যাদি ভেবে ভেবে সময় কত যে নষ্ট করেছি তার ইয়ত্তা নেই।
এরপর একটা সময়ের পরে ঠিক বুঝে গেলাম — আমাকে নিয়ে সৃষ্টিকর্তার প্ল্যানটা ঠিক ছকে বাঁধা নয়। একসেপ্টও করে নিলাম বাস্তবতাটুকু। ব্যাস তখন থেকেই জীবনের মিরাকলগুলো অনুভব করতে শিখে নিলাম। নিজের ভেতরকার অফুরন্ত পজেটিভ প্রাণশক্তি ই হয়ে উঠলো চালিকাশক্তি আমার একার জীবনটাতে। নিজের ভেতরেই যেন আমি পেয়ে গেলাম আমার মহান স্রষ্টাকে। প্রচন্ড মমতা আর ভালোবাসা দিয়ে যিনি সর্বক্ষণ অবলোকন করে যাচ্ছেন এই ক্ষুদ্র বান্দাকে। তখন থেকেই সুখ শান্তি আর স্বস্তির পার্থক্য বুঝে ফেললাম আমি , বায়োলজিক্যাল এইজ হিসেবে উপযুক্ত বয়সের বহু আগেই বৈষয়িক হিসেব না বুঝলেও পৃথিবীর চরমতম সত্য “আমার জীবনটা শেষ পর্যন্ত আমার ই। এর সমস্ত দেনা পাওয়া শুধু এই দুনিয়াতেই না বরং মহান ঈশ্বরের সামনেও জীবনের পাই পাই হিসেবটুকু পর্যন্ত আমাকেই দিতে হবে। জেনে গেলাম আমি।”
(চলবে)
# মিম্ মি
(২য় পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন)
Photo by Michael D Beckwith on Unsplash
[…] (প্রথম পর্ব পড়তে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন) […]
[…] (১ম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন) […]