ইউ ডিজার্ভ এ টাইট হাগ ব্রেভ গার্ল ।
আমার জীবনে ডাক্তার হবার সব থেকে বিশ্রী দিকটা হলো মানুষের মুখোশহীন চেহারাটা দেখে ফেলা। জানি না অন্য ডাক্তারদের এটা হয় কিনা। আমার হয়। বহুবার হাসপাতাল থেকে ঘরে ফিরে রোগীর জন্য মন খারাপ থেকেছে আমার। বিকেলের চা টা আর খাওয়া হয়নি আয়েস করে।রোগীর সুস্থতার জন্য দোয়া করেছি আমি। যতই কসাই বলুন না কেন আপনারা আমাদেরকে আর আমরাও কর্তব্য পালনে কম পেশাদার হই না কেন দিনশেষে রোগীরা তো আমাদের কাছে আরাধনার উপকরণ। আর রোগীর কাছে তার চিকিৎসক সৃষ্টিকর্তার পরের ভরসার স্হল।
কিন্তু সত্যি বলতে কি কখনো কখনো রোগীর লোকেদের রোগীর প্রতি কিছু আচরণ অনেক সময়ই ডাক্তারদের মতো শক্ত মনের মানুষগুলোরও মন খারাপের কারন হয়।
আমি সাধারণত রোগ এবং রোগী নিয়ে লিখতে ভালোবাসি না। কিন্তু আজ লিখতে ইচ্ছে করছে খুব।
ঘটনাটা প্রবলভাবে আমার মনে দাগ কেটেছে।
গতকাল রাতে আমার কর্মস্থলে একজন বাচ্চা ইনজুরড হয়। মাল্টিপল lacerated ইনজুরি ছিল। সবগুলো ম্যানেজ করা গেলেও আপার লিপে একটা কাট ইনজুরি ছিল যেটা যথেষ্ট ডিপ । আর ডান হাতে প্রচন্ড পেইন ছিল।কিছুতেই হাত দিতে দিচ্ছিল না বাচ্চাটা। এক্সরে করাটা জরুরী হয়ে পড়েছিল। লিপ ইন্জুরিটাও বেশ ভোগাবে বলে মনে হচ্ছিল।
প্রাইমারি ম্যানেজমেন্টের পরে রোগী নিয়ে আমি, ডিন, ডর্ম মাষ্টার, নার্স হাসপাতালে ছুটি প্রচন্ড ঝড় বৃষ্টি উপেক্ষা করেই। ওহ সাথে আমার পুত্র আহা নাফকেও নিয়ে নেই। যদিও সবাই বলছিল এত রাতে আপনার বাবুকে নিয়ে যাওয়ার দরকার নেই। কিন্তু আমার জব কন্ট্রাক্ট পরিষ্কার করে লেখা ছিল —– অসুস্থ কোন বাচ্চাকে ক্যাম্পাসের বাইরে কোথাও রেফার্ড বা পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে পাঠাতে হলে আমার অনুমতি ছাড়া পাঠানো যাবে না। এবং যতক্ষণ বাচ্চার প্যারেন্টস হাসপাতালে এসে না পৌঁছবে ততক্ষণ পর্যন্ত ঐ বাচ্চার সমস্ত দায় দায়িত্ব কর্তব্যরত চিকিৎসক হিসেবে আমার।
সুতরাং আমি কিভাবে অসুস্থ বাচ্চাটাকে নার্স আর নন মেডিকেল অফিসারদের উপরে ভরসা করে ক্যাম্পাসের বাইরে পাঠাতে পারি ?
হুমম আমি জানি আমার কলিগরা আমার ভালোর জন্যই বলছিল– ডক্টর তোমার যেতে হবে না। এত রাত তার উপরে ঝড় বৃষ্টি হচ্ছে,যতই অফিসের গাড়িতে যাই না কেন বন জঙ্গলের রাস্তা পুরো অন্ধকার। বিপদ তো ঘটতেই পারে।
এদিকে আহুকে রেখেও যেতে পারছিলাম না। বুঝতে পারছিলাম ফিরতে ফিরতে মাঝরাত বা ভোর হবে।এতখন ছেলেটা একা একা কোয়ার্টারে ভয় পাবে।আমারও অস্হির লাগবে।বরং সাথে থাকলে আমার কলিজাটা শান্তিতে থাকবে।
যাহোক হাসপাতাল থেকে রোগী ম্যানেজ করে আমরা যখন ক্যাম্পাসে ফিরছিলাম পথে দুবার ড্রাইভার সাহেবকে গাড়ি থেকে নেমে রাস্তায় পরে থাকা গাছের ভাঙা ডাল সরাতে হয়েছে। জঙ্গলে ঝড় হলেই ডালপালা ভাঙবেই।ভয়াবহ অভিজ্ঞতা আর রাত জাগার ক্লান্তি সাথে নিয়ে ক্যাম্পাসে ফিরতে ফিরতে রাত প্রায় দুটো বেজে গেল।
ঝটপট ফ্রেস হয়ে ঘুমোতে গেলাম মা ছেলে। সকালে আমার অফিস, আহুর স্কুল আছে। সাড়ে সাতটাতে বের হতে হবে।
সকালে ইনফারমারিতে এসেই মেইল পেলাম বাচ্চাটার প্যারেন্টস আসছে। আমি যেন সব পেপারস রেডি রাখি। নয়টার দিকে প্রিন্সিপালের রুমে নিয়ে যাওয়া হলো বাচ্চাটাকে ইনফারমারি থেকে প্যারেন্টসদের সাথে দেখা করানোর জন্য । এর আগে আমি চেষ্টা করেছি যতটা সম্ভব বাচ্চাটাকে রোগী না বরং হাসিখুশি লাগে এমন করে ব্রেকফার্ষ্ট, মেডিসিন খাইয়ে, ড্রেসিং করিয়ে ফিটফাট করে দিতে। একজন মায়ের জায়গা থেকে বুঝি দু তিনটা ব্যান্ডেজসহ বাচ্চাকে দেখতে হলে বুকের ভেতরে কেমন যে হাহাকার লাগবে।
আধঘন্টা পর বাচ্চাটাকে দিয়ে আসা হলো আবার ইনফারমারিতে। আমি তো পেপারস রেডি করে বসে আছি প্যারেন্টসের হাতে বাচ্চাসহ মেডিসিন বুঝিয়ে দিব বলে। ঘন্টাখানেক অপেক্ষা করে নিজেই খোঁজ নিতে গেলাম কি হলো। ডিন জানালেন ওর প্যারেন্টস চলে গেছে। বলে গেছে— যা যা করার তা যেন আমরা করি। টাকা ব্যাপার না। ও এখানেই থাকবে। বাসায় নেয়া হবে না। বাবা মা দুজনেই ব্যস্ত।কেউ নেই দেখে রাখার। এখানেই বরং ও যত্নে থাকবে।
কেন যেন প্রচন্ড ধাক্কা খেলাম আমি। নিজ সন্তানের শরীরে স্টিচ ব্যান্ডেজ দেখেও তাকে বাসায় না নিয়ে ডর্মে রেখে যাচ্ছে………… কেন যেন নিতে পারছি না আমি।
আমরা আজকাল কী ভীষন আধুনিক হয়ে গেছি তাই না ? এত ব্যস্ততা আমাদের! কার জন্য এত ছুটছি আমরা? সন্তানের ভবিষ্যতের জন্যই তো।তাই না ? কিন্তু বর্তমানেই যদি সন্তান আমার শূন্যতা নিয়ে বড় হয় ভবিষ্যত কি তাহলে খুব productive কিছু হবে আদৌ?
শুধু সন্তান জন্ম দেওয়াটাই কি বাবা মায়ের একমাত্র কাজ ? লালন পালন আদর শাসন সময় এসব দিতে লাগবে না ?!! ভবিষ্যতে এই সন্তান বাবা মা কে সময় দিবে এমন আশা করার কোন কি কারন আছে ?
আমাকে আপসেট হতে দেখে এক কলিগ বলল– ডক্টর সবাই আহ্ নাফের মতো লাকি হয় না। আপনি যা করছেন ওর জন্য বাবা মা দুজনেই মিলেও অধিকাংশ সময় তা করে উঠতে পারে না । ইউ ডিজার্ভ এ টাইট হাগ ব্রেভ গার্ল।
.
#মিম্ মি
ছবি কৃতজ্ঞতাঃ মোহাম্মদ আহ্ নাফ অনুভব ও ডা নাছিমুন নাহার
[…] […]