গর্ভকালীন জটিলতায় একলামশিয়া এবং প্রি – একলামশিয়া

একলামশিয়া এবং প্রি - একলামশিয়া

 

গর্ভকালীন জটিলতায় একলামশিয়া এবং প্রি – একলামশিয়া

সমগ্র বিশ্বে প্রতি বছরই প্রায় পাঁচ লক্ষ মহিলা গর্ভজনিত জটিলতায় মারা যায় । এর মধ্যে শতকরা নব্বই ভাগ মৃত্যুই ঘটে উন্নয়নশীল দেশসমূহে । এর মধ্যে শতকরা ৯০ ভাগ মৃত্যু হয় এশিয়ান ও আফ্রিকান দেশসমুহে, আর এই মাতৃমৃত্যুর হার কমিয়ে আনার লক্ষ্যে উন্নয়ণশীল দেশসমুহে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহন করা হয়েছে ।যার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশেও প্রতিবছর , ২৮ শে মে “ নিরাপদ – মাতৃত্ব দিবস” পালন করা হয় । নিরাপদ মাতৃত্ব ,নারীর বেচেঁ থাকার অধিকার । নারীর অধিকার আছে গর্ভাবস্থায় এবং প্রসবকালীন সময় উপযুক্ত সেবা পাওয়ার তার পরিবার হতে, কমিউনিটি হতে স্বাস্থকর্মীর নিকট হতে এবং সর্বোপরি সরকারের নিকট হতে ।কারণ প্রসবকালীন জটিলতার কারণে বাংলাদেশে প্রতি ঘন্টায় তিনজন মা মারা যায়। আর এই মাতৃমৃত্যুর এক তৃতীয়াংশ ঘটে প্রসব পূর্ববর্তী সমযে এবং অধিকাংশই ঘটে নিজ বাড়ীতে । অবশ্য বর্তমান সময়ে এ অবস্থার কিছুটা উন্নতি লক্ষ্য করা যায় ।

গর্ভজনিত জটিলতার জন্য মাতৃমৃত্যুর কারণ হিসাবে বলা যায়,

১। গর্ভকালীন সেপসিস্ অথবা প্রদাহ ।
২। বাধাগ্রস্থ প্রসব (obstructed labor )
৩। প্রসবের আগে প্রসবপথে রক্তক্ষরণ।
৪। প্রসবের পর অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ।
৫। প্রি একলামশিয়া ।
৬। একলামশিয়া ।

এছাড়াও আরও অনেক কারণ আছে।তবে এসবের ভেতর একলামশিয়া একটি অন্যতম প্রধান কারণ। এটি মারাত্মক ধরনের একপ্রকার খিচুনি রোগ । এই রোগে মা ও শিশু উভয়েরই জীবনের আশঙ্কা থাকে ।আর একলামশিয়া রোগ দেখা দেওয়ার পূর্বের লক্ষণগুলোকে প্রি – একলামশিয়া বলা হয় ।

একলামশিয়া :-
একলামশিয়া রোগে গর্ভবতী মায়ের হঠাৎ খিচুনি শুরু হয় ।এবং এক পর্যায়ে রোগী জ্ঞ্যান হারিয়ে ফেলি । রোগী যদি ঘরে একা থাকেন তবে অনেক বিপদও ঘটে যেতে পারে । যেমন রোগী যদি খাটের উপর বসা থাকেন তবে সেখান থেকে পড়ে গিয়ে মাথায় আঘাত পেতে পারেন অথবা অন্যান্য জায়গায় জখম হতে পারে । এ অবস্থায় যদি পাশে কেউ থাকেন, তবে আস্তে আস্তে রোগীকে শুইয়ে দিতে হবে ,এবং অপেক্ষা করতে হবে কতক্ষণে খিচুনি বন্দ হয় । জোর করে চেপে ধরা ঠিকক নয়।এতে রোগীর ক্ষতি হয়। খিচুনি শেষ হয়ে যাবার পর রোগী যখন শান্ত হয়ে আসে এবং ঘুমিয়ে পড়ে, তখন তাকে একটি ঘরে শান্ত পরিবেশে, অন্ধকার ঘরে রাখতে হবে।অর্থাৎ চোখে যাতে আলো না পড়ে।এরপর অতি সত্বর রোগীকে হাসপাতালে স্থানান্তরিত করতে হবে । এবং চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা দিয়ে রোগীকে সুস্থ করে তুলতে হবে । একলামশিয়া রোগে আক্রান্ত রোগীর গর্ভস্থিত শিশুর মারাত্মক ক্ষতি হবার সম্ভাবনা থাকে এবং শিশুর জীবনও হুমকিস্বরুপ দেখা দেয় । একারণে মা ও শিশু উভয়েরই জীবন রক্ষা করার দিকে চিকিৎসকের খেয়াল রাখতে হবে ।

প্রি – একলামশিয়া :-
প্রি – একলামশিয়ার লক্ষণগুলো হচ্ছে ,রক্তচাপ বেড়ে যাওয়া ,পায়ের পাতায় পানি আসা এবং সেইসাথে প্রস্রাব পরীক্ষা করে যদি দেখা যায় যে প্রস্রাবের সাথে Albumin .নির্গত হচ্ছে তবে বুঝতে হবে রোগীর একলামশিয়া হবার সম্ভাবনা আছে ।
সাধারণত যারা উচ্চরক্তচাপের রোগী তাদেরই গর্ভাবস্থায় রক্তচাপ বেড়ে গিয়ে প্রি – একলামশিয়ার ঝুকিপূর্ণ অবস্থায় চলে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে । প্রি একলামশিয়া হওয়ার তেমন সঠিক কোন কারণ নেই। তবে যেসব রোগীর মাঝে এটা হবার প্রবনতা আছে , তারা হচ্ছে ডায়বেটিক রোগী,অর্থাৎ যাদের গর্ভবতী হওয়ার আগে থেকে ডায়বেটিস রোগ আছে। তাদের প্রি একলামশিয়া এবং তৎপরবর্তী একলামশিয়া রোগ হয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে । এছাড়া প্রথমবার গর্ভবতী হওয়ার বেলায় সাধারণত প্রি একলামশিয়ার লক্ষণ দেখা দেয়। আবার যেসব রোগীর কিডনির রোগ আছে ,অথবা গর্ভের সন্তানের যদি Hemolytic disease .থাকে অথবা গর্ভে যদি জোড়া শিশু থাকে তাহলেও অনেক সময় প্রি একলামশিয়ার লক্ষণ দেখা দেয় । এই সকল ক্ষেত্রে সব সময়ই যে প্রি একলামশিয়া দেখা দেয় তা নয় । তবে সম্ভাবনা থাকে । তাই এইসব রোগীদের বেলায় সজাগ থাকবার প্রয়োজন আছে এই ভেবে যে, তাদের প্রি একলামশিয়া হতে পারে এবং মারাত্মক গর্ভকালীন জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে ।

বাংলাদেশে গর্ভধারণ ও প্রসবজনিত জটিলতায় আক্রান্ত হয়ে যেসব মহিলা বেঁচে যান তার ভেতর অনেক মহিলা এসব জটিলতা থেকে সৃষ্ট অসুস্থতা ও পঙ্গুত্ব নিয়ে বেচে থাকেন ।আবার প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষন করে দেখা গেছে যে ,জীবিত সন্তান প্রসব করে মা মারা গেলে সেসব শিশুদের মধ্যে শতকরা৭৫ ভাগই এক বছর বয়সের মধ্যে মৃত্যুবরণ করে । আর তাই গর্ভধারণ ও প্রসবজনিত জটিলতার হাত থেকে বাঁচতে হলে সকলের মাঝে গনসচেতনত সৃষ্টি করা বিশেষভাবে জরুরী

তেমনিভাবে প্রি একলামশিয়ার হাত থেকে রক্ষা পেতে হলে প্রথমে রোগীকে সচেতন হতে হবে ।এবং প্রিএকলামশিয়া হওয়ার যেসব সম্ভাব্য কারণগুলো আছে সেগুলোর একটিও রোগীর মাঝে দেখা যায় তবে সাথে সাথে ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করতে হবে । অনেক সময় দেখা যায় গর্ভাবস্হার কারনে উচ্চরক্তচাপ অথবা ডায়বেটিস দেখা দেয় ।আবার কখনও অল্পমাত্রার উচ্চ রক্তচাপ বেড়ে গিয়ে জটিল অবস্থার সৃষ্টি করে । আর এসবকিছু ধরা পড়ে গর্ভকালীন সময়ে নিয়মিত চেক আপএর মাধ্যমে । আর তাই গর্ভবতীকে গর্ভকালীন পুরো সময়টাই একজন ডাক্তারের কাছে নিয়মিত চেকআপ করাতে হবে । এর ফলে প্রি একলামশিয়ার লক্ষণগুলো সহজেই ডাক্তারের চোখে ধরা পড়ে এবং সময়মত চিকিৎসা দিয়ে রোগীকে সুস্থ করে তোলা যায় ।

তবে অনেকসময় ডাক্তারের কাছে নিয়মিত চেক আপ করা সত্ত্বেও প্রি একলামশিয়ার মত লক্ষণ দেখা দিতে পারে এমনকি একলামশিয়া শুরু হয়ে যেতে পারে ।এমতাবস্থায় পরিবারের সদস্যদের পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে । এ ব্যাপারে দেরী করলে চলবেনা । অধিকাংশ ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয়ে বিলম্ব হওয়ার কারণে রোগীর মৃত্যু ঘটে । যেমন , যথাসময়ে চিকিৎসা নেওয়ার সিদ্ধান্তে নিতে দেরী হওয়া, রোগীর বিপজ্জনক অবস্থা বুঝতে দেরী হওয়া,সময়মত চিকিৎসাকেন্দ্রে পৌঁছাতে দেরী হওয়া এবং চিকিৎসাকেন্দ্রে পর্যাপ্ত চিকিৎসা পেতে বিলম্ব হওয়া । সুতরাং এই বিষয়গুলোর প্রতি সকলের খেয়াল রাখতে হবে । এছাড়া জরুরী অবস্থার কথা মনে রেখে পরিবারের প্রধানকে কিছু টাকা পয়সা আলাদা করে রেখে দিতে হবে ।রোগীকে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাবার জন্য যানবাহন ঠিকক করে রাখতে হবে । এছাড়া প্রি একলামশিয়াজনিত জটিলতা দেখা দিলে কোথায় রোগীকে নিয়ে যেতে হবে সেকথা আগে থেকে জেনে নিতে হবে ।

এছাড়া যেকোন রকম গর্ভকালীন জটিলতা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য, সকল প্রকার অসুখ বিসুখের জন্য ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হবে । সামান্য অসুখ মনে করে নিজ থেকে কোন ওষুধ খাওয়া ঠিকক নয় । যদি কোন গর্ভবতীর তীব্র জ্বর, মাথাব্যাথা অনিদ্রা,মাথা ঘুরান চোখে ঝাপসা দেখা ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দেয় ,তবে এসব লক্ষণকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিতে হবে এবং যত সত্ত্বর সম্ভব রোগীকে ডাক্তারের কাছে অথবা স্বাস্থকেন্দ্রে নিয়ে যেতে হবে ।

এভাবে একজন গর্ভবতী এবং পরিবারের সকলের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি হলে যেকোনরকম জটিলতা এবং একলামশিয়া ও প্রি- একলামশিয়ার মত মারাত্মক রকমের জটিলতার হাত থেকে রক্ষা পাওয়া এবং সর্বোপরি দেশে মাতৃমৃত্যুর হার কমিয়ে আনা সম্ভব বলে আশা করা যায় ।

একলামশিয়া এবং প্রি - একলামশিয়া

ডা. সওকত আরা বীথি
মিনেসোটা। ইউ,এস,এ।

Related posts

One Thought to “গর্ভকালীন জটিলতায় একলামশিয়া এবং প্রি – একলামশিয়া”

  1. Md shahed imran

    আমার স্ত্রী পি্্র একলামশিয়া রো‌গে আক্রান্ত হ‌য়ে‌ছিল এবং পর পর দু‌টি বাচ্চা মারা যায়। এ বিষ‌য়ে আ‌মি ডা. সওকত আরা বী‌থি ম্যাডা‌রে সা‌থে যোগা‌যোগ কর‌তে চায়। দয়াক‌রে য‌দি উনার সা‌থে যোগা‌যোগের কোন ব্যবস্থা ক‌রে‌দেন তাহ‌লে উপকৃত হব।

Leave a Comment