ডিজিটাল ডিভাইসে আসক্তি শিশুর জন্য ক্ষতিকর

 

 

স্কুলে যেতে হবে না বলে মীম আজ খুব খুশী। সারাদিন ঘরে বসে গেমস খেলা যাবে তাই। ক্লাস ফাইভে পড়ুয়া মেয়ের জন্মদিন উপলক্ষ্যে মা ও আজ অফিস যাননি। মায়ের ইচ্ছা মেয়েকে নিয়ে বাইরে কোথাও ঘুরে আসবেন। কিন্তু মেয়েতো ইদানিং বাইরে যেতেই চায় না। যে মেয়ে কিছু দিন আগেও মা বাবার সাথে কোথাও ঘুরে বেড়ানোর জন্যে উন্মুখ হয়ে থাকতো, সেই মেয়েটা দিনে দিনে কেমন যেনো ঘরকুনো হয়ে যাচ্ছে। সারাদিন স্মা্র্ট ফোনে ডুবে থাকে। বন্ধ করতে বললে মেজাজ খারাপ করে, চিৎকার করে, কাঁদে কিংবা অভিমান করে গাল ফুলিয়ে থাকে। খাবার টেবিলেও চুপচাপ থাকে, খেতে চায় না। ঠিকমতো স্কুলে যেতে চায় না, পড়ালেখায় মনোযোগ কমে গেছে, বাসায় আত্মীয় স্বজন কেউ আসলেও সময় কাটাতে তেমন একটা আগ্রহ বোধ করে না।

আামাদের সমাজে শিশুদের এ সমস্যা দিনে দিনে ভয়াবহ রুপ নিচ্ছে। বর্তমান বিশ্বে আমরা এখন একটা প্রযুক্তির রাজ্যে বাস করছি। আর এই প্রযুক্তির প্রভাবে শিশুরাও আজ প্রভাবিত। অধিকাংশ শিশুরাই এখন ঘন্টার পর ঘন্টা ইন্টারনেটে সময় কাটাচ্ছে। কিম্তু প্রশ্ন আসতেই পারে কিভাবে? শিশুদের তো নিজেদের মোবাইল ফোন থাকে না। আসলে তারা শুরুতে বড়দের ফোন ব্যবহার করে, গেমস খেলে, ইউটিউবে ভিডিও দেখে এবং কম্পিউটারে সময় ব্যয় করে।

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ ইশফি

যুগের সাথে তাল মিলিয়ে উপহার হিসেবেও অনেক সময় খেলনার পরিবর্তে অবুঝ শিশুদের হাতে ভুলে দেয়া হয় স্মা্র্ট ফোন, ট্যাবলেটসহ বিভিন্ন ধরণের ডিজিটাল ডিভাইস। আবার বড়রাও অনেক সময় শিশুকে সামলানোর জন্যে, কান্না থামানোর জন্যে বা খাওয়ানোর জন্যে নিজের মোবাইল ফোনটি শিশুর হাতে দিয়ে দেন কিংবা তাদেরকে কার্টুন চ্যানেলে বসিয়ে রাখেন দীর্ঘ সময়। একাধিক গবেষণার দেখা গেছে যে, ঘুমের পূর্বে যেসব শিশু ডিজিটাল ডিভাইস নিয়ে সময় কাটায় তাদের ঘুম কম হয় বা পরিপূর্ণ ঘুম হয় না। যে কারণে তারা সকালে ঘুম থেকে উঠে সতেজ অনুভব করার বদলে ক্লান্তি অনুভব করে ও তাদের মনোযোগের ঘাটতি দেখা দেয়। এসব শিশু স্বাভাবিকের চেয়ে অধিক ওজনের অধিকারীও হয়ে থাকে।

অত্যাধিক ব্যবহারের ফলে একটা সময় আসে যখন ডিজিটাল ডিভাইস থেকে বের হয়ে আসা কষ্টসাধ্য হয়ে উঠে। এটি মূলত একটি নেশাদ্রব্যের মতোই কাজ করে। সাধারণভ প্রয়োজন ছাড়া কিংবা প্রয়োজনের অতিরিক্ত কোনো কিছু ব্যবহারকে আমরা অপব্যবহার বলে থাকি। নেশাদ্রব্যে অপব্যবহার দীর্ঘস্থায়ী হয়ে গেলে তা যেমন ভাবে অভ্যাসে পরিণত হয় এবং তার উপর নির্ভরতা চলে আসে ঠিক তেমন ভাবেই ইন্টারনেটযুক্ত ডিভাইস অপব্যবহারও নির্ভরতা চলে আসে। পরবর্তীতে তা ব্যবহারের জন্যে একটা বিশেষ তাগিদ অনুভুত হয় এবং ব্যবহার না করা পর্যন্ত অস্বস্তি লাগে। ব্যবহার করার পর স্বস্তিবোধ হয় এবং ধীরে ধীরে এই অপব্যবহারও মাত্রা বাড়তেই থাকে। ক্রমান্বয়ে দিনের একটা বড় অংশই এর পেছনে ব্যয় করা থেকে শুরু হয়ে এক পর্যায়ে তা  শিশুর সৃজনশীল কর্মকান্ডকে ব্যাহত করে ফেলে। ধীরে ধীরে তা শিশুর মানসিক অবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে, ভাবনাকে দখল করে নেয়, আত্মনিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা কমিয়ে দেয় ও একা থাকার প্রবণতা বাড়িয়ে দেয়। টেলিভিশন, কম্পিউটার বা মোবাইলে সময় কাটানোর সময় শিশুর মস্তিষ্কে এক ধরণের উত্তেজনার অনুভূতি তৈরি হয়। ভিজ্যুয়াল এ্যাক্টিভিটিগুলো  রঙ, রূপ, শব্দ, ছবি ইত্যাদি দিয়ে মোহিত করে রাখে তাদের। মস্তিষ্কে এসময় এক ধরণের রাসায়নিক পদার্থ নিঃসরণ হয় যার প্রভাবে তারা একটা নকল জগতের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যায় বা হিপনোটাইজড হয়ে যায়।

হঠাৎ করে সরিয়ে আনলে সেই রাসায়নিক পদার্থ ক্ষরণ কমে যায়, যা এক রকম ফিজিক্যাল শক হিসেবে কাজ করে। এরকম উত্তেজনা কিংবা সুখের অনুভূতি থেকে বড়দেরই যেখানে সহজে বের হয়ে আসা কষ্টকর, ছোটদের বেলায় তো তা রীতিমত ভয়াবহ ব্যাপার।

কাজেই প্রযুক্তির আসক্তি ও এর অপব্যবহার সময়মতো নিরুপনে ব্যর্থ হলে সমস্যাগুলো রোগে রুপান্তরিত হবে। যদিও বর্তমান সময়ে টেকনোলজি থেকে দূরে থাকা কোনোভাবেই সম্ভব না বরং দূরে থাকার চেষ্টা করাটাই আসলে বোকামি; তারপরেও শিশুদের অভিভাবকদের উচিৎ, সন্তানদের ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহারের প্রতি দৃষ্টি রাখা তথা শিশুদের অধিক মাত্রায় ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার থেকে বিরত রাখা। নতুবা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের এই মানসিক বন্ধ্যত্বের দায়ভার পুরোটায় অভিভাবকদেরকেই নিতে হবে।

ডাঃ সুস্মিতা রায়

সহযোগী অধ্যাপক, মানসিক রোগ বিভাগ,

জালালাবাদ রাগীব রাবেয়া মেডিকেল কলেজ, সিলেট।

 

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ  ইশফি

Related posts

Leave a Comment