বাংলাদেশে বেসরকারি মেডিকেল কলেজ একটা ব্যাবসার নাম। ফুলস্টপ।
বাংলাদেশে মোট মেডিকেল কলেজের সংখ্যা কয়টা কেউ জানেন? একটু আন্দাজ করেন।
সরকারি ৩১টা।
বেসরকারি ৬৯টা।
মোট ১০০টা মেডিকেল কলেজ।
সরকারি ডেন্টাল কলেজ ৯টি।
বেসরকারি ডেন্টাল কলেজ ৩৩ টি।
মোট ৪২টি ডেন্টাল কলেজ।
আমার জানামতে এত ছোট দেশে এত মেডিকেল কলেজ পৃথিবীর অন্য কোন দেশে আছে। বিশেষ করে এত গুলো প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ।
দুইটা বিল্ডিং ভাড়া নিলেই হয়ে যায় এখন একটা বেসরকারি মেডিকেল কলেজ। একটা বিল্ডিং নামকা ওয়াস্তে ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল আরেকটা একাডেমিক ভবন। আর পাশে একটা খোপ খোপ করা কবুতরের বাসার মত একটা হোস্টেল থাকলে একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ মেডিকেল কলেজের চ্যায়ারম্যান আপনি।
বিদেশী কোটার নামে লাখ লাখ টাকার বিনিময়ে ছাত্রছাত্রী কাশ্মীর নেপাল কোলকাতা থেকে এনে ভর্তি করবেন। টাকার ঘাটতি? কিছু নির্দিষ্ট সংখ্যক ছাত্রছাত্রী প্রফেশনাল পরীক্ষায় আটকে রাখেন, তাদের থেকে বেতন তো পাবেনই সাথে ফর্ম ফিলাপের সময় বিভিন্ন ছুতায় টাকা নিয়ে পকেট ভারি করতে পারবেন।
বেসরকারি মেডিকেল কলেজ এবং হাসপাতাল গুলো কোন মানবসেবার অংশ নয়। এগুলা ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান। এরা স্টুডেন্ট দের জীবন নিয়ে ব্যাবসা করে। একজন ছাত্রকে বেতন দিতে হয় ১০-১৫ হাজার। অমুক ফি, তমুক ফি লেগেই থাকে।
ধরুন ১০০ জন পরীক্ষার্থী যে কোন একটি প্রফে। ৭০ জনকে সেই পরীক্ষা দেয়ার অনুমতি দেয়া হয়। ৩০ জন গেলো ঝরে। ৩০ জন মাসে মাসে আবার বেতন দিয়েই যাচ্ছে।
যেই ৭০ জন বসলো, সেখান থেকে ৪০ জন, বড় জোর ৫০ জন পাশ করে। বাদ গেলো ২০ জন।
প্রতি ছয় মাস পর পর পরীক্ষা, সো, ছয়মাস পরে বসলো বসতে না পারা ৩০ জন আর ফেল করা ২০ জন। তারা আবার ফর্ম ফিলাপ করে। আবার পরীক্ষা দেয়। আবার ফেল করে। তাদের সাথে যোগ হয় নতুন ব্যাচ। উঠে যায় টাকা, এর থেকে কঠিন ব্যাবসা আর কোথায় আছে?
আর কিছু বাঁধা কাস্টমার তাদের থাকে। তাদেরকে বিভিন্ন প্রফেশনাল পরীক্ষায় আটকে রাখা হয়। তারা মাসের বেতন গুনতে থাকে। আর পরীক্ষা দিতে থাকে।
ক্যালকুলেটর নিয়ে যদি বসেন কোন মেডিকেলের মালিক, এই প্রফে আটকাবো ৩০ জন, এই প্রফে ৩০ জন, তার পরেরটায় ৩০ জন। ৯০ জন। তারা বেতন ধরি দেয় ১০ হাজার, যা নূন্যতম যে কোন মেডিকেলের জন্য, হিসাব করেন কত টাকা হয়। কেন মেডিকেল কলেজ ব্যবসায় নামবেন না তিনি!!
হাসপাতালে নাই রোগী, আর প্রফে এক্সটারনাল আসে ঢাকা মেডিকেলের ঘাগু মাল। কপাল কুঁচকে বলে, দেখছো কোনদিন অমুক রোগের পেশেন্ট? মনে মনে স্টুডেন্ট বলে, ফি আমানিল্লাহ বলে অন্ধকার গহ্বরে ঝাপ দিলাম। কারন রোগী তো আসে কালে ভাদ্রে। এমন রোগের নামই শুনি নাই, রোগী তো দুরের কথা।
রোগীর অপ্রতুলতা, রোগীর গায়ে হাত দিয়ে একজামিনেশন না করার ফল ভোগ করতে হয় তখন। তখন স্টুডেন্টের মুখ ফুটে খুব বলতে ইচ্ছে করে, স্যার, আমি জীবনে মারমার শুনি নাই, আমার জীবন কাটছে মামা-ওয়ারড বয়ের উপর একজামিনেশন প্রাকটিস করে।
আর প্রতিটা মেডিকেল কলেজেই একটা দুইটা পা চাটা প্রফেসর থাকবে। তাদের কাজ একটাই, কলেজের মালিকের পা চাটা। তারা কলেজ মালিক যদি বলে আজকে সূর্য পশ্চিমে উঠবে, তারা বলবে, জি স্যার, ঐ দিকেই উঠবে। যদি চ্যায়ারম্যান বলে, আজ সূর্য উঠবে না, তারা বলবে, জি স্যার, উঠবে না।
আর আপনি ভালো প্রফেসর হয়ে, চ্যায়ারম্যানের অবাধ্য হয়ে বেশী ছাত্র ছাত্রী পাশ করান কিংবা ভুলেও বলে ফেলেন, স্যার, সূর্য তো পূর্বেই ওঠে, আপনি চাকরীচ্যুত হবেন পরের দিনই। এম,ডি এফসিপিএস করা এক জন প্রফেসরকে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দেবে কোন এক মূর্খ মালিক।
তবে বেসরকারি মেডিকেলে জ্যাক থাকলে চিন্তা নাই। জ্যাক মানে উপরের লেভেলের ফোন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কারো ফোন, কোন সচিবের ফোন, এম্পি কিংবা ওই লেভেলের কারো ফোনে অনেকেরই পাশ হয়ে যায়। তাদের সাথে এক্সটারনাল হেসে হেসে মজা করে, ইন্টারনাল মুচকি হাসে, ভুল হলে এক্সটারনালই বলে, ‘এত নার্ভাস হলে হবে? আমি জানি তুমি পারো, বাদ দেও, তুমি রেডিয়াল পালস দেখাও।’ আর অন্য দিকে এফসিপিএস সমতুল্য প্রশ্নের জবাব দিয়েও পাশ হয় না উপরের জ্যাকবিহীন অনেক ছাত্রের।
আর ইন্টার্ন লাইফ? হসপিটাল ডিরেক্টর এর দুর্ব্যবহার, চ্যায়ারম্যানের দুর্ব্যবহার, তাদের পা চাটা কিছু প্রফেসরদের হম্বি তম্বিতে আপনার দিন গুনতে হবে, কবে বের হবেন এখান থেকে।
আর বের হন ইন্টার্ন করে, পদে পদে ধাক্কা খাবেন, গালি খাবেন, প্রাইভেট থেকে পাশ করছেন, কিছু পারেন না, অমুক তমুক। কিন্তু আপনি কিভাবে তাদের বোঝাবেন, আমাদের মাজা তো প্রাইভেট কলেজ কবেই ভেঙ্গে দিছে। তারপরও আমাদের প্রাইভেট মেডিকেলের অনেকেই শাইন করতেছে, এন্ড দে নো, কতটা দুর্বার পথ তাদের পাড়ি দিতে হয়েছে। কতটা বৈষম্য তারা ফেইস করেছে।
বেসরকারি মেডিকেল কলেজ এর আর কিছু কাল্প্রিট থাকে মেডিকেলের অফিস ভবন। কলেজের চ্যায়ারম্যানের কাছে ভুল তথ্য উপস্থাপন, ভর্তি বাণিজ্যে নিজের পকেটে টাকা ভরার তালে নষ্ট করে পুরো প্রতিষ্ঠানকে।
একটা মেডিকেল কলেজের অনুমোদন নেব ভাবছি। কারন মেডিকেল কলেজ এলাকার মোড়ের ফার্মেসির মত হয়ে গেছে। ফার্মেসি খুলো, এন্টিবায়োটিক বেচো, গ্যাসে ঔষধ বেঁচো, স্টেরয়েড মারো, ব্যাবসা করো। রোগী মরুক বাচুক, সমস্যা নাই।
বাংলাদেশে বেসরকারি মেডিকেল কলেজ একটা ব্যাবসার নাম। ফুলস্টপ।
লিখেছেনঃ
ডা তানজির ইসলাম বৃত্ত (সিডাটিভ হিপনোট্রিক্স)