নারীর প্রজনন অধিকার ও স্বাস্থ্যরক্ষা

প্রজনন অধিকার ও স্বাস্থ্যরক্ষা

 

।।।।–নারীর প্রজনন অধিকার ও স্বাস্থ্যরক্ষা–।।।

 

প্রজনন অধিকার
ডাঃ সওকত আরা বিথী। মিনিসোটা। ইউ. এস. এ।

নারীর প্রজনন অধিকার ও স্বাস্থ্যরক্ষা  সম্পর্কে লেখার আগে প্রয়োজন বোধ করছি একটি ভূমিকা দেবার। আমার লিখিত এই নিবন্ধটি প্রায় বিশ বছর আগে রেডিও বাংলাদেশ বেতারে প্রচারিত হয়েছিল। আজ মনে হোল, এই বিষয়টির উপযোগিতা আজও হারায়নি বিশেষ করে গ্রাম গন্জের নারীদের এবং তাদের পরিবারবর্গের জন্য। তবে শহরের আধুনিক নারীদেরও জানবার বিষয় আছে বৈকি।

আমাদের আজকের সমাজে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নরীর অধিকার নিয়ে নানাবিধ আলোচনা ও সমালোচনা হতে দেখা যাচ্ছে। এটা সুখের কথা। কারন আমাদের এই পুরুষ শাসিত সমাজে বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে নারীর অধিকার, সমাজের বিভিন্ন স্তরে নারীর অধিকার এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এমনকি নারী তার নিজের গৃহে কতখানি অধিকার পায় সেটা নিয়েও ভাববার সময় এসেছে আজ। সেইসাথে ভাবতে হবে নারীর প্রজনন অধিকার ও স্বাস্থ্যরক্ষার কথা।

প্রজননের ক্ষেত্রে নারীর অধিকার থাকতে হবে বৈকি। কারণ সংসারে একটি শিশুর জন্মের প্রয়োজনে নারী ও পুরুষ অর্থাৎ স্বামী স্ত্রী উভয়কেই সমান অংশ নিতে হয়। এর পরবর্তী পর্যায়ে নারীর গর্বধারন হয় এবং দীর্ঘ নয় মাস সাত দিন সময় পর্যন্ত গর্ভে সন্তান ধারন করে সংসারের সব দায়িত্ব, সামাজিক কাজকর্ম সবকিছুই চালিয়ে যেতে হয়। গর্ভধারনের এই বাড়তি কষ্ট প্রকৃতিগতভাবেই মা কেই অর্থাৎ নারীকেই বহন করতে হয়। তাহলে এই প্রজননের ক্ষেত্রে নারীর মতামত দেওয়ার অধিকার অবজ্ঞা করা হবে কেন? বরং নারীর অধিকার সর্বাগ্রে গণ্য করা উচিত। কারণ আমাদের এই পুরুষ শাসিত অনগ্রসর সমাজে এক্ষেত্রে নারীর কোন অধিকার বা মতামতের কোন মূল্যই দেওয়া হয়না অধিকাংশ ক্ষেত্রে। আরও মজার কথা হচ্ছে আমাদের নারীরাও এক্ষেত্রে সচেতন নয় তেমনিভাবে নারীদের সচেতন হওয়ার প্রয়োজন আছে এই কারণে যে প্রজননের ক্ষেত্রে নারীর স্বাস্থ্যরক্ষার বিষয়টি ওতপ্রতভাবে জড়িত। একজন নারীর শারিরীক অবস্থা বিবেচনা করে সন্তান নেবার সঠিক সময় কোনটি হবে, নিরাপদ মাতৃত্বের পরওবেশ তার পরিবারে আছে কিনা ইত্যাদি নানা বিষয়ে চিন্তা করে সন্তান নেবার সিদ্ধান্ত নারীকেই নিতে হবে। তবে সে সিদ্ধান্ত সর্বাগ্রে স্বামীর সাথে আলোচনা সাপেক্ষে হওয়া প্রয়োজন। এরপর পরিবারের আর সকলকেই সে সিদ্ধান্তের মূল্য দেওয়া প্রয়োজন এরপর পরিবারের সকলকেই সে সিদ্ধান্তের মূল্য দেওয়া উচিত। কারণ গর্ভধারন করলে পরিবারের সকলকে, গভাবস্থায়, প্রসবের সময় প্রয়োজনীয় সকল প্রকার সেবা, পরিচর্যা ও চিকিৎসা যেন তার নাগালের মধ্যে থকতে পারে সে চেষ্টা করতে হবে। এক কথায় নিরাপদে মা হওয়ার জন্য অনুকুল পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। কারণ বংলাদেশে প্রতি ঘন্টায় তিনজন মহিলা সন্তানধারনজনিত জটিলতায় মারা যায়
এই তথ্য জনবার পর একজন নারীর নিরাপদে মা হওয়ার অধিকার নিশ্চয়ই তারই থাকা উচিৎ। এক হিসেবে এ তার বেচে থাকার অধিকার। তাই বলে
সন্তানধারণ বিষয়টি নিয়ে ভীত হওয়া ঠিক নয়। তবে মোটামুটিভাবে বলা যায়, সন্তানধারন করলে জটিলতা দেখা দেওয়ার একটা ঝুকি থেকে যায়। গর্ভাবস্থায় সন্তান প্রসবের সময় এমনকি প্রসবের পর ছয় সপ্তাহ পর্যন্ত নানারকম জটিলতা দেখা দিতে পারে। যে নারী সন্তান ধারন করেন তাকে এই কথাটিই মনে রাখতে হবে। এরপর পরিবারের সকলকেই এ বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে। তাহলে, এক্ষেত্রে প্রজজন অধিকারের বিষয়টি সহজ হয়ে যায়।

-২য় পর্ব-
সন্তান ধারনের ক্ষেত্রে জটিলতা নানাভাবে আসতে পারে। এক্ষেত্রে নারীর বয়স বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে। সাধারণত গ্রমান্চলের পরিবারে অনেক সময় দেখা যায় মেয়েদেরকে অল্প বয়সে বিয়ে দেওয়া হয়। এবং পরিবারের মুরুব্বী দের অনুরোধে অল্প বয়সেই, নাতি নাতনি দেখবার আশায় বৌদেরকে গর্ভবতী হতে বাধ্য করা হয়। এটা মোটেই ঠিক নয়।২০ বছর বয়সের আগে এবং ৩৫ বছর বয়সের পরে গর্ভধারন করলে মা ও শিশু উভয়ের স্বাস্থ্য বপন্ন হয়। এছাড়া দুইটি সন্তান ধারনের মাঝে সময়ের ব্যবধান দুই বছরের কম হলে সেই শিশুদের মৃত্যু ঝুকি শতকরা ৫০ ভাগ বেড়ে যায়। আবার চারটের বেশী সন্তান নিলে গর্ভাবস্থায় ও প্রসবের সময় মায়ের স্বাস্থ্য নষ্ট হওয়ার ঝুকি খুব বেশী থাকে। এসব তথ্য জানবার পর একটি কথাই বেরিয়ে আসে, তা হচ্ছে সন্তান নেওয়ার সঠিক সময়টি প্রত্যেক বিবাহিতা নারীকে জানতে হবে।

তবে শুধু স্ত্রী নয়, স্বামীকেও জানতে হবে এবং গর্ভধারন এড়াবার জন্য স্বামী স্ত্রী উভয়ের জন্যই নিরাপদ ওগ্রহনযোগ্য বেশ কিছু পদ্ধতি রয়েছে। কখন প্রথম সন্তান নিতে হবে, কত সময়ের ব্যবধানে সন্তান নিতে হবে এবং কখন সন্তান নেওয়া বন্ধ এসব তথ্য ও উপায় একজন পরিবার পরিকল্পনাকর্মী স্বামী স্ত্রীকে বলে দিতে পারেন। তাহলে দেখা যাচ্ছে গর্ভধারনের কারণে জটিলতা এবং মৃত্যু ঝুকি এড়ানোর জন্য পরিবার পরিকল্পনারও প্রয়োজন আছে এবং মহিলাদের পাশাপাশি পুরুষদেরও পরিকল্পনার সুফল এবং বিভিন্ন পদ্ধতি সম্পর্কে জানা অবশ্য কর্তব্য।

এছাড়া আমাদের দেশে অনেক সময় ছেলে সন্তানের আশায় বারবার সন্তান নেওয়ার প্রবনতা দেখা যায়। এবং অনেক ক্ষেত্রে মেয়ে সন্তান জন্ম দেওয়ার ব্যাপারে নারীকেই দায়ী করা হয় এমনকি ছেলে সন্তানের প্রয়োজন দেখিয়ে পুরুষদেরকে একাধিক বিয়ে করতেও দেখা যায়। এটি মোটেই ঠিক নয়। কারণ ছেলে সন্তান জন্ম দেওয়ার ব্যাপারে নারীর কোন ভুমিকা নেই। ভুমিকা আছে পুরুষের। নারী ও পুরুষের মিলনে গর্ভধারণ ঘটে একথা ঠিক । কিন্ত সন্তান ছেলে না মেয়ে হবে তা মহিলার উপর নির্ভর করেনা বরং পুরুষের উপর নির্ভর করে তাই নারীকে এ ব্যপারে দোষারোপ করা রীতিমত অন্যায় বলা যায়। এবং নারীদের এ বিষয়টি জানা প্রয়োজন যাতে করে তাদের উপর অহেতুক দোষ চাপিয়ে বারবার গর্ভবতী হওয়ার দায় না চাপিয়ে দেওয়া হয়। অর্থাৎ প্রজজনের অধিকার তাকেই নিশ্চিত করতে হবে

তবে এ অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে হলে সবার আগে নারীকে সচেতন হতে হবে।

৩য় ও শেষ পর্ব:
সচেতন হতে হবে এই কারণে যে, গর্ভধারনজনিত জটিলতার কারনে তার জীবনের ঝুকি দেখা দিতে পারে। কিছু কিছু মারাত্মক লক্ষণ আছে যেগুলির একটি অথবা কয়েকটি লক্ষণ একসাথে দেখা দিলে বুঝতে হবে গর্ভবতী মহিলা মারাত্মক জীবনের ঝুকির মধ্যে পড়তে পারে। যার ফলে মৃত্যুও হতে পারে। লক্ষণগুলি হচ্ছে ,
১। প্রসবের আগে প্রবেশপথে রক্তক্ষরন অথবা প্রসবের পর অতিরিক্ত রক্তক্ষরন ।
২। তীব্র মাথা ব্যাথা এবং অথবা চোখে ঝাপসা দেখা।
৩। হাত পা ফুলে যাওয়া
৪। অত্যধিক বমি হওয়া।
৫। খিচুনি হওয়া।
৬। তীব্র জ্বর।
৭। ১২ ঘন্টার বেশী সময় ধরে প্রসবব্যাথা চলতে থাকা।
৮। দুর্গন্ধযুক্ত যোনিস্রাব।
৯। প্রসবপথে গর্ভস্থ সন্তানের মাথার পরিবর্তে অন্য কোন অংশ দেখা যাওয়া।

এইসব লক্ষণগুলো দেখা দিলে অতি সত্তর রোগীকে নিকটবর্তী স্বাস্থকেন্দ্রে বা হাসপাতালে নিতে হবে। একটুও বিলম্ব করা যাবেনা। এবং পরিবারের সদস্যদেরকে আগে থেকেই জরুরী পরিস্থিতির মোকাবিলা করবার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। অর্থাৎ গর্ভধারন বিষয়টিি মোটেই হেলাফেলা করবার মত কিছু নয়। রীতিমত দায়িত্বপূর্ণ কাজ। তাই নারীকেই নানাদিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে কখন গর্ভধারন করা ঠিক হবে। কারণ এর সাথে তার নিজের স্বাস্থ্য ও জীবনরক্ষার দিকটিও উপেক্ষা করা যায়না।
তাই স্বামীর সাথে আলোচনাসাপেক্ষো নারীকেই তার প্রজজন অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। এবং এ ব্যাপারে আমাদের সমাজের পুরুষদেরও এগিয়ে আসতে হবো। মহিলা মৃত্যুর হার কমিয়ে আনার লক্ষে গর্ভবতী মহিলা এবং প্রসুতির জন্য পর্যাে্প্ত সেবাযত্নের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। কোন মহিলা যেন সহিংস এবং অন্যায় আচরনের শিকার না হয় সেদিকেও নজর দিতে হবে। স্নেহশীল পিতা ভাই এবং স্বামী হিসেবে নারীর প্রতি পুরুষের বিশেষ দায়িত্ব সবাইকে স্বীকার ও সমর্থন করতে হবে। এবং সর্বোপরি প্রজজনের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহনে নারীর অংশগ্রহন নিশ্চিত হলে এবং সমাজ ও জাতি গঠনে তদের অবদান স্বীকার করা হলে তদের অবস্থান দৃঢ় হবো এবং দেশ ও জাতি গঠনে নারীরা আরও সচেতন ভুমিকা রাখতে সক্ষম হবে।
-শেষ-

 

Related posts

Leave a Comment