ডাক্তার হওয়াটাই মনে হয় আজন্ম পাপ হয়েছে
দিন, ক্ষণ, তারিখ গুলিয়ে ফেলছি! মাথা আউলা হয়ে গিয়েছে চিন্তা করতে করতে, কিভাবে শুরু, কবে, কখন, কোথায় কি হচ্ছে! ডাক্তার হওয়াটাই আমাদের আজন্ম পাপ!
ক্লাস ফাইভ, এইট, SSC, HSC তে স্কলারশিপ পেয়েছিলাম। ক্লাস সিক্স থেকে MBBS পর্যন্ত কোন বেতন লাগেনি, বরং স্কলারশিপের টাকা পেতাম। সরকারি স্কুল, কলেজ, মেডিকেলে পড়ালেখা করেছি।BSMMU (স্বায়ত্তশাসিত) তে যখন পড়তে আসি (ততদিনে বিসিএস হয়ে গিয়েছে) তখন সরকার আমাকে ডেপুটেশন দেয়। বেতন পেতাম, সরকারী টাকায় পড়ালেখা শেষ করি। পোস্টিং পাই দেশের অন্যতম সেরা মেডিকেল কলেজ গুলির একটিতে, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে, পেশায় আমি মাইক্রোবায়োলজির লেকচারার। আল্লাহ আমার ভাগ্য অনেক সুপ্রসন্ন রেখেছেন, নয়তো কেন আমি দেশের সেরা বিদ্যাপীঠগুলোতে পড়ালেখার সুযোগ পাব। বাবা চট্টগ্রাম সরকারি কলেজের উপাধ্যক্ষ ছিলেন। বোন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের পেডিয়াট্রিক্স এর কন্সাল্টেন্ট, ভাতৃবধু অনকোলোজিস্ট (আর্মির মেজর)। বাবার আদরশে অনুপ্রাণিত হয়ে আমরা দুই বোন সরকারী চাকরীতে ঢুকেছি। সরকারী টাকায় পড়ালেখা করেছি, তাই জনগনের প্রতি দায়বদ্ধ আমি। ডাক্তারী করিনা, তবে ডাক্তারদের বেসিক গড়তে বদ্ধপরিকর। নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনার বর্ণনা দিলাম।
ঘটনা – ১ঃ আমার বোন তখন আট মাসের প্রেগন্যান্ট। ওর ডেলিভারী ডেট ছিল আরো একমাস পরে। রোজার শেষের দিকে। আমি আমি ফাইনাল প্রফ ক্যান্ডিডেট তখন। ঈদের ছুটি কাটাতে সিলেট থেকে চট্টগ্রাম এসেছি। ঈদের দিন সকালে দাদার বাড়ি যাব বলে রেডি হচ্ছিলাম৷ হঠাৎ খবর এলো আপির লেবার পেইন উঠেছে। ভাবলাম ওরতো এত তাড়াতাড়ি লেবার পেইন উঠার কথা নয়। বাসার সবাই মিলে ক্লিনিকে গিয়ে দেখি প্রিম্যাচিউর লেবার পেইন উঠে গিয়েছে। ড্রিপ চলছে, শাহানা ম্যাডাম এসে দেখে গিয়েছেন। ওর মামাশশুর মামি শাশুড়ি দুজনেই ডাক্তার। উনারাও ক্লিনিকে। আপি বারবার বলছে, “মামি আপনি বাসায় যান। সারা বছর বাচ্চাদের সময় দিতে পারেন না, ঈদের দিনটাতে অন্তত বাচ্চাদের কাছে থাকেন”। ওনারা গেলেন না। দুপুর বারটার আপির কোল আলো করে এলো আমাদের নাবিল বাবু, শাহানা ম্যাম ডেলিভারী করিয়ে হাসিমুখে বাসায় গেলেন। আমি তখনো ডাক্তার হইনি। আমার মনে হলো ঈশ্বরের কাছাকাছি এই মানুষটি যার ঈদ, ছুটি বলে কিছু নেই। ছুটে এসেছেন মানবতার টানে।
ঘটনা – ২ঃ ২০০২ সাল তখন, আমার ইন্টার্নশিপ চলছে, সার্জারী ওয়ার্ডে প্লেসমেন্ট। সেদিনের এডমিশন নাইটে ছিলেন আমাদের এসিস্ট্যান্ট রেজিস্টার ভ্রাতৃতুল্য মেহেদী ভাই, সাথে ওনার ইন্টারন আমরা কয়েকজন নব্য ডাক্তার। রাত বারটায় স্ট্যাব ইঞ্জুরির এক রুগী এলো। কারা যেন ছুরি মেরে ফেলে গেছে। রাস্তার লোকজন দয়াপরবশ হয়ে ওয়ার্ডে দিয়ে গেল। হায় হায় এই রুগী কেমনে ম্যানেজ করি এখন? মেহেদী ভায়ের বাহিনী আমরা পুওর ফান্ড ঘেটে স্যালাইন, ক্যাটগাট, স্যালাইন সেট, গজ, মাইক্রোপোর নিয়ে ফিল্ডে নেমে পড়লাম। ভাইয়া ওটি শুরু করলেন, সাথে তিন জন জুনিয়র এসিস্টেন্ট আমরা। এবডোমেন ওপেন করতেই দেখি লিভার ইঞ্জুরি, গলগল করে ব্লাড বের হচ্ছে। সাকার মেশিন নষ্ট, কাপ দিয়ে সেচে রক্ত ফেললেন। ইন্টেস্টাইনাল ইঞ্জুরি ছিল। ভাইয়া স্মুথলি ওটি শেষ করলেন। পরদিন খবর পেয়ে রুগীর লোক এলো। আমরা অই রুগী ফলো আপ দেই রেগুলা, ড্রেসিং করি, রুগী ইম্প্রুভ করতে থাকে। সাত দিন পর সেলাই কেটে রুগী বাড়ী ফেরত গেল। মেহেদী ভাইয়ার মাঝে মনে হলো আবারো ঈশ্বরের মত কাউকে দেখলাম।
ঘটনা – ৩ঃ
২০০১ সালের ঘটনা, গাইনী ওয়ারডে ইন্টার্নশিপ করছি। সেদিনের নাইট ডিউটিতে আমাদের সাথে সিনিয়র হিসাবে ছিলেন এসিস্ট্যান্ট রেজিস্টার সুলতানা আপা। রাত একটা বাজে লেবার পেইন নিয়ে এলো প্রেগ্ন্যান্ট এক রুগী। আল্টাসনোগ্রাফি রিপোর্ট দেখে সবার মাথা ঘুরে গেল। প্লাসেন্টা প্রিভিয়া (lateral) indication হচ্ছে সিজার। এই রুগী নরমাল ডেলিভারী করানো খুবি রিস্কি। রুগী লেবারে চলে গিয়েছে, সিজার করারও সুযোগ নেই। রুগী খুবি গরীব, রুগীর স্বামীকে খুব অল্প কিছু মেডিসিন আনতে দিলাম। সুলতানা আপা রিস্ক নিয়ে ফোরসেপ দিয়ে membrane rupture করে দিলেন, এম্নিওটিক ফ্লুইড বের হয়ে গেল। অাপা বাচ্চা ডেলিভারী করলেন স্মুথলি। আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মত আপার কাজ দেখলাম। রুগীর স্বামী যখন মেডিসিন নিয়ে এলো ততক্ষণে সব ম্যানেজ হয়ে গেছে। লোকটির মুখে কৃতজ্ঞতার হাসি, চোখে আনন্দাশ্রু।
ঘটনা – ৪ঃ
আমার প্রথম পোস্টিং ছিলো রাঙামাটির কাউখালী উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। ইভনিং আর নাইট ডিউটি করতে হত বিধায় আমার আম্মাও থাকতেন আমার সাথে হেলথ কম্পলেক্সে। সেখানে রুগী ম্যানেজ করার জন্য ছিলোনা পর্যাপ্ত ব্যাবস্থা। এক বিকালবেলা severe pneumonia য় আক্রান্ত ছয়মাস বয়সী এক শিশু এলো। সেখানে ছিলোনা কোন নেবুলাইজার মেশিন, বাচ্চাদের স্যালাইন দেয়ার জন্য specialized nurse, শুধু অক্সিজেন চালু করে দিয়েছি। বাচ্চার অবস্থা খারাপ হয়ে যাওয়ায় তাকে সদর হাসপাতালে রেফার করি। পথে যেতে যেতে বাচ্চাটা মারা যায়। লোকাল লোকজন (এবং আরো কিছু লোক যারা নিজেদের সাংবাদিক বলে পরিচয় দেয়) আমাকে তেড়ে দৌড়ে আসে মারতে। আমি যে ডরমিটরিতে থাকতাম সেখানকার কলাপ্সিবল গেটে তালা লাগানো ছিলো। তাই বেঁচে যাই সে যাত্রায়। আম্মা সাহস দিচ্ছিলেন ভয়ে আক্রান্ত তার কন্যাকে। নাহলে আমিও হতাম ভিক্টিম।
মাগুরায় গুলিবিদ্ধ প্রেগন্যান্ট মাকে সিজার করে মা বাচ্চা দুজনকেই সুস্থ করে তোলা, খাদিজাকে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে আনা, ডাস্টবিনে কুড়িয়ে পাওয়া বাচ্চাটিকে প্লাস্টিক সার্জারি করে নতুন জীবন দেয়া, বৃক্ষমানবকে অপারেশন করে সারিয়ে তোলা এসবতো বাংলাদেশ এর ডাক্তাররাই করেছে তাইনা।
ক্লিনিসিয়ান নই আমি। ক্যারিয়ার করেছি বেসিক সাব্জেক্টে। হবু ডাক্তারদের পড়াই। নিজে অনেক পড়ালেখা করি, অনেক যত্ন করে সন্তানসম ছাত্রছাত্রীদের পড়াই। ওদের চোখে বড় ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখি, আলোড়িত হই। পরক্ষণেই মনে হয় কি ভয়াবহ জীবন অপেক্ষা করে আছে ওদের জন্য।
এত অন্যায়, এত অবিচার, সবার এত এত পোস্ট দেখে আমি বিক্ষুব্ধ, হতবিহবল। আমি ভালো লিখতেও পারিনা। ভেবেছিলাম লিখবোইনা কিছু। হাত আগাচ্ছিলোনা লিখতে। কিন্তু আমি দায়বদ্ধ, ফরেসিন মেডিসিন পাশ করেছি Geneva declaration মুখস্থ এবং আত্নস্থ করে। মানবসেবার ব্রত নিয়ে এগিয়ে গিয়েছি চিকিৎসক হওয়ার দ্বারপ্রান্তে। আমার SOMC (আমার মেডিকেল কলেজ), BSMMU, আমার শিক্ষকগণ সর্বোপরি সমগ্র doctor community র প্রতি আমার অনেক ঋণ। সেই ঋণ একটু হলেও শোধ করতে চাই। এই অন্যায়ের প্রতি প্রতিরোধ গড়ে তোলার সময় হয়েছে।
এত কিছুর পরও বিশ্বাস করি মানবতাই আমাদের ধর্ম।
We are born to serve. To establish the humanity is our ultimate aim. That’s why we doctors are unique, unparalleled. My outfit is my white – coat, my ornament is my stethoscope, my food is my medical book, my relative is my patient. My profession, my strength, my hard work, my dignity, my self – respect make me different from others.
ডা. নাজমুন নাহার দিনা