#আমার_Confession, #আমার_প্রতিশ্রুতি…
১…..
আমি কিছুটা বিরক্ত। টেবিলের ওপাশে প্রায় ৬ ফুট লম্বা কালো কুচকুচে চেহারার এক লোক বসে আছেন।তুর্কি সেনাপতি ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজীর সাথে এর চেহারার বেশ মিল থাকার কথা।লোকটির চোখেমুখে বেশ খুশীর ঝিলিক, অবশ্য চিকিৎসককে এক হাত নিতে পারলে কে না খুশি হয়?….
লোকটি তার স্ত্রীকে নিয়ে গত সপ্তাহে এসেছিলেন। তার স্ত্রীর সমস্যা শুনে ঢাকার এক ল্যাব থেকে Complete Blood Count এবং Thyroid function test করে নিয়ে আসতে বলেছিলাম। উনি সেটা মানেননি। স্থানীয় এক ক্লিনিকে উনার পরিচিত লোক আছে, সেখান থেকে ডিসকাউন্টে তিনি পরীক্ষাগুলো করে নিয়ে এসেছেন।চিকিৎসক নির্দেশিত ল্যাবে পরীক্ষা করায় বোকারা, সেখানে চিকিৎসককের সাথে ল্যাব কর্তৃপক্ষের এক ধরণের গুজুরগাজুর ফুসুরফাসুর থাকে, উনি তো আর বোকা নন, এগুলো তিনি বোঝেন, তার চোখেমুখে খুশীর ঝিলিকটা সেকারণেই….
আমিঃ পরীক্ষাগুলো ঢাকায় করতে বলেছিলাম, এখানে করালেন কেন?…
খিলজী সাহেবঃ পরীক্ষাগুলা তো এখানেও হয়, আপনে যেখানে করতে বলছেন সেখানেই করতে হইব-এইটা কেমন কথা!(চোখের ঝিলিক আরো বাড়লো)
আমিঃ আপনাকে দেখে তো শিক্ষিতই মনে হচ্ছে। এক কাজ করুন-আপনার স্ত্রীর রিপোর্ট আপনিই খুলুন…
খিলজী সাহেব বুকপকেট থেকে চশমা বের করে চোখে লাগিয়ে ইনভেলপ খুলে রিপোর্টে চোখ বুলানো শুরু করলেন…
আমিঃCBC তে ESR বলে একটা ব্যাপার আছে, পেয়েছেন?
খিলজী সাহেবঃজ্বি, তাতে কি?
আমিঃ রেজাল্টটা ৩২ কিনা দেখেন…
রিপোর্টে চোখ বুলিয়ে খিলজী সাহেবের থুতনী একটু ঝুলে গেলো, তিনি ঢোক গিললেন…
আমিঃ থাইরয়েড ফাংশন দিয়েছিলাম, ঐটা দেখেন তো। TSH টা দেখেন।২.৫৭ বা ৩.৬১ এর যেকোন একটা হবার কথা। কত দিয়েছে?
খিলজী মিয়া এবার ধরাশায়ী হলেন।থুতনী আরো ঝুলে গেলো, আলজিভটাও দেখা যাচ্ছে। বুঝলাম আমার কোপ ঠিক জায়গামতই পরেছে…
খিলজী মিয়ার কাছে এটা অবাক কান্ড হলেও আমার জন্য মুখস্থ রিপোর্ট বলে দেয়া খুব একটা কঠিন কিছু ছিলো না, প্রান্তীয় অঞ্চলের কোন কোন ল্যাব কিভাবে রিপোর্ট লিখে সেটা আমরা যারা চিকিৎসক তাদের ভালোই জানা আছে। হাসপাতালের মাসিক সমন্বয় সভায় এসব ভূয়া রিপোর্ট নিয়ে কথাও উঠেছিলো….
পরীক্ষাগুলো আবার ঢাকার নির্দেশিত ল্যাব থেকে করে নিয়ে আসতে বলে বখতিয়ার খিলজী সাহেবকে বিদায় দিতে হলো….
২….
মধ্যযুগে মুসলিম শাসনামলে এদেশে উজবেকিস্তান থেকে কিছু লোকের আগমন ঘটে।এরা ছিলো ভাড়াটে সৈন্য, গায়েগতরে এরা বেশ শক্তসমর্থ হলেও বিচার বিবেচনায় এরা ছিলো প্রিমিটিভ পর্যায়ের। বাংলা ভাষায় ‘উজবুক’ শব্দের উৎপত্তি কিন্তু এখান থেকেই।সেই ‘উজবুক’রা এখন আর এদেশে আসে না, তবে চিকন বুদ্ধির বাঙালিরা বেশি চিকনা বুদ্ধি প্রয়োগ করতে গিয়ে নিজেই কিন্তু মাঝে মাঝে ‘উজবুক’ হয়ে যায়। নমুনা দেই….
এলাকার এক বিশিষ্ট উঠতি আধুনিক সমাজসেবক কাম পাতি লীডারের কাহিনী শোনাই। সমাজসেবা করতে করতে ডাক্তারের কাছে আসার সময় তিনি পান নাই।তাই তার সমস্যার ব্যাপারে নেট ঘেটে মনে হয়েছে ডাক্তারের কাছে একেবারে এন্ডোসকপি করে যাওয়াটাই ভালো।উনি তার এন্ডোসকপি রিপোর্ট আমার দিকে ঠেলে দিলেন….
প্রেসক্রিপশন ছাড়া যেকোন ল্যাব এ গিয়ে নিজের খেয়ালখুশিমত এন্ডোসকপির মত একটা ইনভেসিভ টাইপের পরীক্ষা করা যেতে পারে- এটি আমার ধারণাতে ছিলো না, সেবারই প্রথম ধারণাটি পেলাম।বয়স হচ্ছে, ধীরে ধীরে এদেশে আরো কত ধারণা পেতে হয় কে জানে?…
লীডার সাহেবকে অ্যাসেস করলাম। Dyspepsia এর পেশেন্ট, অ্যালার্মিং কোন ফিচারও নেই, এধরণের ক্ষেত্রে আমরা সাধারণত কোন পরীক্ষা দেই না, সাময়িকভাবে কিছু ওষুধ খেতে দেই। কথাবার্তা শুরু করলাম….
আমিঃ লীডার সাহেব, ডাক্তার না দেখিয়ে নিজে নিজে এন্ডোসকপি করাটা কি ঠিক হলো?
পাতি নেতাঃ আগের বার আসলে তো এইটাই করতে দিতেন, তাই নিজেই বুদ্ধি কইরা এন্ডোসকপিটা করায় ফেললাম। দেখেন তো কি বুদ্ধি! প্রথমবার ভিজিটের টাকাটা দিতে হইলো না….( একথা বলেই তিনি হো হো করে হেসে উঠলেন)
যেখানে কোন পরীক্ষা লাগে না সেখানে কয়েকশ টাকা ভিজিটের ভয়ে ২০০০ টাকা দিয়ে এন্ডোসকপি করে নিয়ে আসলেন। আবার হাসিও দিচ্ছেন! ভোদাই আর কাকে বলে!
তার হো হো হাসির রেসপন্সে আমিও মুচকি হাসি দিলাম । উনিও হাসছেন, আমিও তার দিকে তাকিয়ে হাসছি। ভাগ্য ভালো, এক মানুষ আরেক মানুষের মনের কথা টের পায় না, টের পেলে উনার হাসি বহু আগেই থেমে যেতো…
৩…..
ভদ্রলোক সৌদিতে থাকেন, দেশে ২ মাসের জন্য বেড়াতে এসেছেন। সৌদির আলো হাওয়া গায়ে লাগিয়ে তিনি এখন বেশ তরতাজা, ওজন ১১৫ কেজি। ওজন কমানোর বেশ কিছু নন-ফার্মাকোলজিক্যাল অ্যাডভাইস দেবার পর আউটডোরের টিকিটে Orlistat ড্রাগটি লিখে দিলাম….
কিছুক্ষণ পর তিনি আবার রুমে ফিরে আসলেন। এক একটা Orlistat এর দাম ৫০ টাকার মত। ৩ টাকার টিকিটে এত দামী ওষুধ কেন দেয়া হচ্ছে-এটা নিয়ে তিনি প্যাঁচানো কথাবার্তা শুরু করলেন। আমি যতই তারে বুঝাই যে এটি ছাড়া এ মুহূর্তে আর কোন রেকমেন্ডেড ড্রাগ নেই, উনার কোমড়ের বেড় সহ্য করতে না পেরে নিতম্বে নেমে যাওয়া জিন্সের প্যান্ট কোমড়ে বারংবার টেনে উনি ততই কথার মাঝে থুথু ছিটিয়ে আমাকে নাজেহাল করে চললেন। সামনে থাকা এক রেজিস্টার খাতাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে কোন রকমে তার ছিটানো থুথু থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে যাচ্ছিলাম….
ঠিক সে সময়েই তার সামনে রুমের ভেতর চশমা পড়া এক লোক ঢাউস একটা কালো ব্যাগ হাতে ঢুকে পড়লেন। “মোটে মিয়া” লোকটাকে ওষুধ কোম্পানীর প্রতিনিধি মনে করলেন। বিলিভ ইট অর নট, “মোটে মিয়া” আমার সামনেই ঐ লোকের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠে বললেনঃ” ঘুষ টুষ দিয়া দামী দামী ওষুধ তো ভালোই লেখায় নাও….”
বেচারা তার হাতের ব্যাগ নামিয়ে রুমাল দিয়ে তার চশমা পরিষ্কার করা শুরু করলেন…
এ কথা বলতে পারার পর তিনি বোধ হয় একটু আরাম অনুভব করলেন। তিনি এবার ক্ষ্যান্ত দিলেন, একহাতে প্রেসক্রিপশন আর অন্যহাতে জিন্সের প্যান্ট টানতে টানতে বিদায় নিলেন। ভাবলাম একবার ডাক দিয়ে লুঙ্গি পরার পরামর্শ দেই, থুথুবর্ষণের কথা চিন্তা করে পরামর্শ দেয়ায় ইস্তফা দিলাম….
যাই হোক, আমার পরামর্শ তার ভালো লাগে নাই। চিকিৎসক যে চিকিৎসাই দেন না কেন-সেটা ফার্মেসীওয়ালা দিয়ে ভেরিফাই না করার আগ পর্যন্ত এদেশের মানুষের শরীরে এক ধরণের চুলকানী চলতে থাকে। চুলকানী থামাবার জন্য তিনি তার বাল্যবন্ধু কাম ফার্মেসীওয়ালার কাম পার্ট-টাইম ডাক্তারের শরণাপন্ন হলেন। বাল্যবন্ধু তারে ৫০ টাকার Orlistat বাদ দিয়ে ১.৫০ টাকার Thyrin ট্যাবলেট ধরিয়ে দিলেন, ওজন কমানোর সেটা নাকি অব্যর্থ ওষুধ…..
এখানে একটা কথা বলে রাখা ভালো। শরীরে থাইরয়েড হরমোনের ঘাটতি হলে অনেক রকম সমস্যা দেখা দেয়, ওজনও বাড়তে দেখা যায়। ট্রিটমেন্ট হিসেবে আমরা Thyrin/Thyrox tablet দিয়ে থাকি, অন্যান্য সমস্যার সমাধানের সাথে সাথে Thyrin/Thyrox tablet শরীরের ওজনও নানা মেকানিজমে কমিয়ে থাকে। তবে বুঝে শুনে এই ট্যাবলেটের ডোজ ঠিক না করলে বিপদ আছে….
বাল্যবন্ধুর পরামর্শে সেই Thyrin এর তৃতীয় ডোজ গেলার পর বুকে প্রচন্ড ব্যথা নিয়ে রাত দুইটায় কুঁই কুঁই করা অবস্থায় আমার সাথে তার আবার দেখা হয় হাসপাতালের ইমার্জেন্সী রুমে। ECG তেও হার্ট এটাক চলে আসলো। লোডিং ডোজ দিয়ে NICVD রেফার করলাম…..
৪….
কি একটা আজব দেশেই না বসবাস করি যে দেশের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক লোক তাদের দেশের চিকিৎসককে অবিশ্বাস করে!অথেনটিক ল্যাবে পরীক্ষা করতে পাঠালে এরা মনে করবে কমিশনের ধান্ধা, Recommended drug যদি একটু দামী হয় তবে মনে করে ওষুধ কোম্পানীর টাকা খেয়ে সেটা লেখা হয়েছে। কারো কারো অবিশ্বাস এত বেশী যে চিকিৎসকদের ভিজিটের টাকাটা দিতে পর্যন্ত এদের অনীহা। কিভাবে এই ভিজিটের টাকাটা বাইপাস করা যায় সে ব্যাপারে এদের ফন্দিফিকিরেরও অন্ত নেই…..
অসুস্থ অবস্থায় এরা যখন সবচেয়ে অসহায় থাকে তখন এরা সাহায্য নিতে আসে এদেশের সবচেয়ে অবিশ্বাসী ডাক্তারদের কাছ থেকে। লেখাপড়া করে এদেশের সর্বোচ্চ শিক্ষিত যে ডাক্তাররা-তারা নাকি বসে থাকে তাদেরকে গলা টিপে মেরে ফেলার জন্য–এই হলো এদেশের মানুষের কনসেপ্ট! এর চেয়ে প্যাথেটিক আর কিই বা হতে পারে!আমার কিন্তু এদের জন্য মায়াই লাগে….
ভালো খারাপ সব পেশায় আছে। তাই বলে এদেশের চিকিৎসকরা সব নিজের স্বার্থের জন্য করে এমন ধারণা করাটা রোগীর জন্যও কিন্তু ভালো না।চিকিৎসকদের যারা অবিশ্বাস করে বেশীরভাগ ক্ষেত্রে তাদের পরিণতি কিন্তু আমি ভালো হতে দেখি নাই, উপরের উদাহরণগুলো কিন্তু তারই প্রমাণ বহন করে। আমার কাছে মনে হয়েছে- চিকিৎসকদের প্রতি অবিশ্বাস একটি মানসিক রোগ, এ শ্রেণীর লোকেরা একটা Vicious Circle এ ঢুকে যায়। এই বৃত্তের পরিসমাপ্তি ঘটে রোগীর করুণ পরিণতির মধ্যে দিয়ে….
৫….
রোগী হিসেবে চিকিৎসা নেবার জন্য আমাদের কাছে যারা আসেন, তাদের প্রায় প্রত্যেকের মনের ভিতরটা কিন্তু আমরা দেখতে পাই। সে বড় অদ্ভুত জগৎ। কারো মনের জগতটা শ্বেতশুভ্র, কারো জগতটা গহীন অন্ধকারে ঢাকা। বিবেকের কাছে যাতে দায়বদ্ধ থাকতে না হয় সেজন্য একটা সার্টেইন লেভেল পর্যন্ত সবাইকেই কিন্তু চিকিৎসা দিতে হয়…
তবে শ্বেতশুভ্র লোকগুলোকে যখন রোগী হিসেবে পাই-তখন কেন যেন নিজের অজান্তেই মনটা ভালো হয়ে উঠে। চিকিৎসা কমপ্লিট হবার পর এই রোগীগুলো যখন চলে যায় তারপরেও কিন্তু এই শ্বেতশুভ্র লোকগুলোকে নিয়ে আমাদের চিন্তা হয়। ক্লান্তিকর দিনশেষে নিদ্রায় যাবার আগে একবার হলেও চিন্তা করি–লোকটি সুস্থ হবে তো?আর কিছু কি আমার করার বাকী ছিলো?সৃষ্টিকর্তা লোকটির সাথে সুস্থ অবস্থায় আবার আমার দেখা করাবেন তো?
একটা কনফেশন আজ করেই ফেলি।অনন্ত আশা নিয়ে, আমাদেরকে ভরসাস্থল মনে করে, শ্বেতশুভ্র খোলা মন নিয়ে যারা আমাদের শরণাপন্ন হন-তাদের অবহেলা কিন্তু আমরা কখনও করি নাই, তাদের অবহেলা আমরা কখনো করতেও পারবো না….
ডাঃ মোঃ আসাদুজ্জামান