কাভি কাভি হারনা জরুরী হ্যায়

কাভি কাভি হারনা জরুরী হ্যায়

হাসপাতালে আমি পারত পক্ষে রোগী ভর্তি দেই না। হাসপাতাল কোন মধুজগত না যে চাইলেই কাউকে ভর্তি দিতে হবে, এর আনাচে কানাচে ভয়ঙ্কর জীবাণু ঘাপটি মেরে থাকে।এক অসুস্থ ব্যক্তি থেকে এই ভয়ঙ্কর জীবাণু আরেক ব্যক্তির মাঝে সংক্রমিত হতে পারে, মেডিকেলীয় পরিভাষায় ব্যাপারটাকে Cross infection বলে। অপ্রয়োজনে রোগী ভর্তি করে তাকে Cross Infection এর ঝুঁকির মাঝে ফেলে দেয়াটা কোন কাজের কথা হতে পারে না….

হাসপাতালে রোগী ভর্তি নিয়ে এত বিতং করে কথা বলার কারণটা বলি।আমার সামনে এই মুহূর্তে যে ইয়াং ম্যান বসে রয়েছেন তিনি হাসপাতালে ভর্তি হতে চাচ্ছেন। শারীরিক দুর্বলতা, অনিদ্রা, খাদ্যে অরুচি–এই হলো তার কমপ্লেইন।ফিজিক্যালি এমন কোন সাইন নাই যে এ সমস্ত সমস্যায় তার ভর্তি হওয়াটা আবশ্যক । আমি প্রেসক্রিপশনে প্রাথমিক চিকিৎসা লিখে, ভর্তি হবার প্রয়োজন নেই-সেটা জানিয়ে ইমার্জেন্সী রুম থেকে উঠে নিজের রুমে চলে এলাম….

রুমে বসে পেপার পড়ছি।দরজা নক করার শব্দে পেপার রেখে দরজা খুলে দেখি সেই ইয়াং ম্যান দাঁড়িয়ে আছেন।কথোপকথন নিম্নরূপ:

–আবার কি হলো?
–স্যার, আমার ভর্তি হওয়াটা জরুরী…
–কি যন্ত্রণা! আমি তো বলেছি আপনাকে ভর্তি হতে হবে না…
–(ইতঃস্তত করে)স্যার, আমার স্ত্রী আজ সকালে রাগ করে বাসা থেকে তার বাবার বাসায় চলে গেছে।আমি হাসপাতালে ভর্তি আছি এটা শুনলে সে চলে আসবে। প্লিজ স্যার, আমাকে একটু ভর্তি করে দেন….

ইয়াং ম্যানের চোখে এক ধরণের আকুতি ছিলো, হতাশা ছিলো।এই আকুতি অগ্রাহ্য করা কষ্টকর…

–নাম কি?
–অমিত(ছদ্মনাম)
–স্ত্রী বাসা থেকে চলে গেল কেন?
–কথা কাটাকাটি হইছিলো স্যার
–শুধুমাত্র কথা কাটাকাটিতে তো চলে যাবার কথা না…

অমিত চুপ করে রইলেন…

আমি দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে বললামঃ যান, ভর্তির কাগজপত্র নিয়ে আসেন, ভর্তি করে দিচ্ছি।ঝামেলা মিটায়ে তাড়াতাড়ি বাসায় চলে যান…

অ্যাডমিশন শীটে Generalized weakness under evaluation ডায়াগনোসিস লিখে অমিত সাহেবকে ভর্তি করলাম। এরপরে অবশ্য আরো হ্যাপা পোহাতে হয়েছে, উনি যে হাসপাতালে ভর্তি সেটা উনার স্ত্রীকে আমাকে ফোন করে জানাতে হয়েছে, কারণ অমিতের ফোন কল উনার ওয়াইফ রিসিভ করেন নাই…

এইসব হাবিজাবি কাজকর্মের মোটামুটি ঘন্টাখানেক পর বিকেলের দিকে হাসপাতাল লাগোয়া টং দোকানের বিস্বাদ চা খাচ্ছিলাম।চারদিকে অন্ধকার হয়ে আসছে, ঝড় আসবে বোধ হয়। দেখলাম শাড়ী পরা এক তরুণী হন্তদন্ত হয়ে রিকশা থেকে নেমে হাসপাতালের ভেতরে ঢুকে গেলেন। বুঝতে পারলাম ইনিই অমিত সাহেবের স্ত্রী…

কিছুক্ষণ পর অমিত সাহেবের স্ত্রী কান্না কান্না চেহারা নিয়ে ভর্তির ফাইল সহ টং দোকানে আমার কাছে ছুটে আসলেন…

–স্যার, আমি অমিতের স্ত্রী, উনার সমস্যা কি খুব বড়?
–ইয়ে, একটু সমস্যা তো আছেই..
–(শাড়ীর আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে) ঢাকায় নিতে হবে?
–নাহ, এখানেই চিকিৎসা করা যাবে, চাইলে বাসায় নিয়েও চিকিৎসা করাতে পারবেন। তবে বেশী করে যত্ন নিতে হবে….
–তাইলে স্যার আমাদের ছুটি দিয়ে দেন, বাসায় নিয়ে চিকিৎসা করি…

তার কিছুক্ষণ পর আমি ছুটির কাগজ লিখছি, অমিতের স্ত্রী আমার সামনে দাঁড়িয়ে চোখ মুছছেন।এই নারী জাতিটাকে আমার কাছে একটু অদ্ভুতই লাগে। একটা নারী কতটুকু অপমানিত হলে স্বামীর বাসা ছেড়ে যায়-সেটি বুঝতে কারোই কষ্ট হবার কথা নয়। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ঐ একই নারী এখন তাকে অপমান করা সেই স্বামীকে নিয়েই উদ্বিগ্ন। এই সমীকরণ মেলানো আমার জন্য কিছুটা কষ্টসাধ্য তো বটেই। রবিঠাকুর যথার্থই বলেছেঃ “মেয়েরা যেখানে দুঃখ পাইবে সেইখানেই তাদের হৃদয় দিতে প্রস্তুত….”

হাসপাতাল ছেড়ে চলে যাবার আগে অমিত আমার সাথে একা দেখা করতে এলেন।ভর্তির সময় তার চোখেমুখে যে ডিপ্রেশন দেখেছিলাম, তার লেশমাত্র এখন নেই..

–স্যার, চলে যাচ্ছি, দোয়া করবেন
–আমার মত পাপী লোকের দোয়া আপনার লাগবে না। তবে একটা কথা বলি,কথাটা মনে রাখতে পারলে ভালো। আপনার স্ত্রী আত্মিকভাবে আপনার অংশ, তাকে কষ্ট দিয়ে আপনি সুখে থাকবেন-এটা কিন্তু সম্ভব না। …

উনি এইবার আমার চোখে চোখ রেখে বললেন-“স্যার, আর ভুল হবে না…”

আমি তার চোখের দিকে তাকালাম।সেই চোখে প্রতিশ্রুতি ছিলো, মানুষের মুখ মিথ্যা কথা বলতে পারে, চোখ পারে না, চোখকে মনের কথা বলতে হয়। আমি এই প্রথমবারের মত তার কাঁধে আমার নির্ভরতার হাত রাখলাম…

অমিত তার স্ত্রীকে নিয়ে চলে গেলেন।ততক্ষণে বিকেল শেষে গোধূলী হয়ে এসেছে ।আমি হাসপাতালের বারান্দা থেকে তাদের দিকে তাকিয়ে ছিলাম।অমিতের স্ত্রী পরম মমতায় অমিতকে ধরে রিকশায় তুলছেন। দু’জনে রিকশায় উঠামাত্র ঝমঝম করে বৃষ্টি শুরু হলো, অদ্ভুত সুন্দর পরিবেশ। রিকশাওয়ালা রিকশার হুডটি তুলে দিলেন। রিকশাটাও দেখি নতুন! প্রকৃতি মাঝে মাঝে কত সুন্দর ভাবেই না নাটকের মঞ্চায়ন করে!

তারপরে বহুদিন চলে গেছে। কোন এক বৃষ্টিস্নাত রাতে খাবার খেতে খেতে নিজের স্ত্রীকে ঘটনাটা বলেছিলাম। পুরো ঘটনা শোনার পর তার মন্তব্য ছিলোঃ “হয়ত লোকটার উপকার হয়েছিলো, কিন্তু তুমি Ethically হেরে গেছো, এথিক্যাল পয়েন্টে এ লোককে হাসপাতালে ভর্তি করার কোন কারণ নেই…”

আমি তার দিকে তাকালাম। আমি হেরে যাওয়াতে তার চোখে মুখে খুশীর ঝিলিক।মাথায় কিছু কথা ঘুরছিলো, সেগুলো আর বলা হয় নাই। আমি চেয়েছিলাম তার চেহারায় খুশীর ঝিলিকটি অমলিন থাকুক…

তবে আপনাদের কিছু কথা বলি।এটা সত্য যে, দুটি মনকে জোড়া দিতে গিয়ে এক মামুলি রোগীকে আমি হাসপাতালে ভর্তি করেছিলাম। Ethical পারস্পেক্টে আমি হার স্বীকার করে নিচ্ছি। জীবনে কিন্তু মাঝে মাঝে হারতে হয়, সে হারার মাঝে আনন্দ আছে, সে হারাটা কিন্তু আসলে হারা নয়। হিন্দী মুভি আমার খুব একটা দেখা হয় না, কিন্তু নব্বই এর দশকে শাহরুখ খান অভিনীত ‘Baazigar’ মুভির কয়েকটা লাইন আমার মনে আছে। লাইনগুলো বলে বিদায় নিলামঃ

“কাভি কাভি কুছ জিতনে কে লিয়ে কুছ হারনা জরুরী হোতা হ্যায়, লোকনে ইস হারকে জিতনেওয়ালে কো বাজিগার কেহতে হ্যায়’….”

লিখেছেন
জামান আলেক্স
রিকশা Rickshaw

ছবি কৃতজ্ঞতা -হিমাদ্রী শেখর রায় ও ডা সংগীতা হালদার রায়

Related posts

Leave a Comment