উপড়ানো অস্তিত্ব – এবরশন ।। মিমি হোসেন

উপড়ানো অস্তিত্ব - এবরশন

উপড়ানো অস্তিত্ব – এবরশন

 

এর আগে কোনো এবরশন ছিলো আপনার, নাকি এবার ই প্রথম?

– জ্বি এবারই প্রথম।

– বিয়ে হয়েছে কত বছর?

– আগামী মাসে আমাদের প্রথম এনিভার্সারি।

– হিসেব টা কি আমাকে একটু ক্লীয়ারলি বলা যায়! আমি আপনার পুরো হিস্ট্রিটা জানতে চাচ্ছি।

– লাস্ট সেপ্টেম্বর আমাদের বিয়ে হয়, আমি ডিসেম্বর মিস করি, সে পর্যন্ত আমার সবকিছু রেগুলার ছিলো, দু চারদিন আগুপিছু হলেও মোটামুটি রেগুলার। তারপর মার্চে এসে এবরশন হয়ে যায়।

– ঠিক বুঝলাম না…

আমাদের কথোপকথনের ঠিক মাঝখানে সিস্টার এসে আমাকে জানায়, পেশেন্টের বাবা এসেছে, আমার সাথে কথা বলতে চাইছে। সকালে আমার সিনিয়র কন্সাল্টেন্ট আমাকে বলে গেছেন আমি যেনো পেশেন্টের বাবাকে কাউন্সেলিং করে কন্সেন্ট পেপারে সাইন নিয়ে সবকিছু রেডি রাখি।

তিন দিন আগে মেয়েটি প্রচন্ড স্বাস কষ্ট নিয়ে ভর্তি হয়,সাথে অন্যান্য উপসর্গ। তার বয়স, কম্পলেইন আর সিম্পটমসের সাথে আমাদের ডায়াগনসিস তখনো কোনো কনফার্মেশনে যাচ্ছিলোনা।

আমরা মেলাতে পারছিলাম না। নানারকম ডিফারেন্সিয়াল ডায়াগনসিস আমরা রাখছিলাম কিন্ত কনফার্ম হওয়া যাচ্ছিলোনা। তবে এতোটুকু কনফার্ম হওয়া গিয়েছিলো যে পেশেন্টের অন্তত হার্টে কোনো সমস্যা নেই, তার স্বাস কষ্টের কারণ হার্ট নয়। তার ফুসফুসের পর্দায় পানি জমায় এই স্বাস কষ্ট হচ্ছিলো। তবে পানি জমার কারণ তখনো অজানা থাকায় আমরা কোনো ফাইনাল ডায়াগনসিসে যেতে পারছিলাম না। তখন প্ল্যান ছিলো, এই পানি বের করে তা পরীক্ষায় পাঠিয়ে এর কারণ বের করতে হবে, আর তাই মেয়েটির বাবাকে ডেকে পাঠানো।

তার আল্ট্রাসনোগ্রাফিতে পেলভিক কালেকশন (জরায়ুর আশপাশের অংশে পানি জাতীয় কিছু/ বর্জ্য) থাকায় আমরা একজন গাইন্যাকের ও স্বরনাপন্ন হই, আর সেখান থেকে তার এই রোগের কিছু অস্পষ্ট কিন্ত গুরুত্বপূর্ন তথ্য বেরিয়ে আসে, আর সেই অস্পষ্ট কিন্ত গুরুত্বপূর্ন তথ্য কে স্পস্ট করবার দায়িত্ব আমার সিনিয়র কন্সাল্ট্যান্ট যখন আমাকে দিয়ে যান, আমি উপরোক্ত কথোপকথনের মাধ্যমে তা বের করে আনতে চেষ্টা করি।

তার আগে গাইন্যাক ম্যাডামের কাছে সে বলেছিলো যে তার একটি এবরশনের হিস্ট্রি আছে, কিন্ত ব্যাপারটা তখনো ধোয়াশায় ছিলো। আর আমার উপর দায়িত্ব ছিলো ডিটেইল জানার।

সকালে হ্যান্ডওভারের সময় রুগীর ডিটেইলস জানার পাশাপাশি এটেন্ডেন্টের কোনো স্পেশালিটি থেকে থাকলে সেটাও বলে দেয়ার নিয়ম। যেমন অমুক ঐ মন্ত্রনালয়ের অমুক, তমুক সেই টিভির তমুক ধরণের খবরাখবর আর কি।

এই পেশেন্টের বাবা কোনো একটি জেলার ডিসি অথবা কাছাকাছি পর্যায়ের কোনো একজন উচ্চপর্যায়ের আমলা স্থানীয়। যাই হোক, তিনি যখন আমার সাথে কথা বলার জন্য অপেক্ষা করছিলেন, আমি ঠিক সেই সময় মেয়েটির হিস্ট্রি নিতে সবে শুরু করেছিলাম। ঠিক তখনি পেশেন্টের বাবা এবং স্বামী আসেন…

– আমাকে ডাকা হয়েছে।

-জ্বি, আমাদের কিছু ফর্মালিটিস আছে, যেকোনো প্রকার প্রসিডিউরে যাবার আগে আমাদেরকে আপনার অনুমতি নিয়ে কিছু পেপার্সে সাইন দিতে হবে। আপনি বোধহয় জানেন আজ আমরা পেশেন্টের ফুসফুসের পর্দায় জমে থাকা পানি বের করবো।

– সব – ই বুঝলাম, কিন্ত গত তিন দিন ধরে আপনারা নানারকম টেস্ট করে যাচ্ছেন, এখনো বলছেন টেস্ট করবেন, তারমানে এখনো আপনারা সাগর হাতরাচ্ছেন, আমার মেয়ের কি হইছে তা বের – ই করতে পারলেন না এখনো! আর এইসব সই সবুতের কারণ কি!

আমি আমার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় কাউন্সেলিং কে পার্ট অব ট্রিটমেন্ট বলে মনে করে মোটামুটি ধৈর্য নিয়ে পেশেন্টের এটেন্ড্যান্ট দেরকে কাউন্সেলিং করে থাকি। তাই পেশেন্টের বাবার ছোঁড়া তীর যে আর পাঁচজন সাধারণ এটেন্ড্যেন্টদের মতো না, বুঝতে পেরে আমি একটু নড়েচড়ে বসলাম, যাতে তার তীর লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। কারণ আমি তখন এতোটুকু বুঝে গিয়েছিলাম যে, এই রহস্য সমাধানের বেশ কাছাকাছি আমরা আছি। আমি তখন তাকে বুঝিয়ে বললাম…

– বাবা, একটা সাধারণ ক্যানুলা অথবা ইনভেসিভ ( চিকিৎসার কারণে বাইরে থেকে শরীরে প্রবেশ করার মাধ্যমে যে কোনো প্রসিডিউর) কোনো কিছুর কারণে পেশেন্ট খারাপ হয়ে যেতে পারে অনেকসময়।

– খারাপ মানে? হোয়াট ডু ইউ মিন!

– শী ক্যান বি কলাপ্সড, দো ইটস ভেরি রেয়ার বাট….
তিনি আমার কথা শেষ করতে না দিয়েই বলে উঠলেন..

– কলাপ্স করলে কেইস করে দিবো হাস্পাতালের নামে বুঝলেন ম্যাডাম!

আমি ছোট একটা হাসি ঠোঁটের কোনে রেখে বললাম।

– এনি টাইম স্যার, ইউ ক্যান, ইটস ইউর রাইট। অবশ্য ই কেইস করে দেবেন। এমন কোনো হাস্পাতাল কি আছে যাদের নামে কেইস নেই। কেইস করা আপনার অধিকার।

তিনি আর কথা বাড়ালেন না৷ পেশেন্টের স্বামী হয়তো আঁচ করতে পারছিলেন যে আমাদের কথা উলটো পথে এগুচ্ছে, তাই তিনি দ্রুত বাধা দিয়ে স্বশুরকে অনুরোধ করলেন পেপার্সে সই করে দিতে।

ডকুমেন্টস রেডি করে আমি আবার পেশেন্টের কাছে গেলাম।

বাইশ তেইশ বছরের ছিপছিপে গড়নের মেয়েটি, কিছুদিনের শারীরিক ধকল তার উজ্জ্বল চেহারা বেশ মলিন করে দিয়েছে যদিও তবু তার প্লাকড আই ব্রাউস আর ম্যানিকিউরড আঙুল আমার চোখ এড়িয়ে যায়নি। তাকে দেখে যথেষ্ট ফ্যাশন সচেতন বলেই মনে হয়েছে আমার। এবার আমি কাগজ কলম নিয়ে তার বেডের পাশে পুরোদস্তুর তৈরি হয়েই গেলাম, আমাকে বের করতেই হবে তার পুরো হিস্ট্রি।

– আপনার প্রেগন্যান্সির কতো সপ্তাহে এবরশন হয়?

– তিন মাস। আমি আসলে বুঝতে পারিনি।

– কি বুঝতে পারেন নি?

– আসলে প্রথম দুইমাস যাবার পর যখন তিন মাসে পরে তখন আল্ট্রাসাউন্ড করে জানতে পারি, এরপর এবরশন হয়ে যায়।

– এবরশন হয়ে যায়! তিনমাসে কি করে এমনি এবরশন হয়ে গেলো? আপনি কোনো ঔষধ খেয়েছিলেন?

-জী না, আমি আসলে বুঝতে পারিনি।

– বুঝতে পারেন নি নাকি আপনি বাচ্চাটা চান নি।

ওপাশে নিস্তব্ধতা।

– কিভাবে এবর্ট করালেন বাচ্চা? নিজে কিছু করে নাকি?

– না না, আমরা এটা চাচ্ছিলাম না, তাই একজন বিশেষজ্ঞের মতামত নিয়ে হস্পিটালে ভর্তি হয়ে নরমাল ডেলিভারী করে ফেলি।

আমি এতক্ষন চুপ করে শুনছিলাম, লিখতে ইচ্ছে করছিলোনা আর এই হিস্ট্রিটুকু।

এর একদিন পর পেশেন্টের জন্য একটি বোর্ড করা হয়, আর তাতে তার হিস্ট্রি এবং যাবতীয় ইনভেস্টিগেশন রিপোর্ট থেকে ফাইনালি ডায়াগনোসিস হয় যে, ইনকম্পলিট এবরশন আর রিটেইন বিট অফ প্রোডাক্ট ইন ইউটেরাস ( অসম্পুর্ণ গর্ভপাত এবং জরায়ুর ভেতর বর্জ্য থেকে যাওয়ায়) থাকায় সিভিয়ার সেপ্টিসেমিয়ার কারণে তার এতোকিছু ডেভেলপ করে।

এতক্ষন আমি ছিলাম এই গল্পের প্রথম অংশে, এবার আসি দ্বিতীয় অংশে।

এই বোর্ডে একটা ব্যাপার পরিষ্কার হয় যে সেই বাবা নিজেই জানতেন না তার মেয়ে খুব সাধারণ ভাবে নিজের ভেতর ধারণ করতে থাকা একটি রক্তের দলাকে জঞ্জাল মনে করে উপড়ে ফেলার কারণেই যে এতো ভয়ংকর অবস্থার সম্মুখীন আজ। এরপর যে কদিন তিনি আসতেন, মাথা নিচু করে আসতেন, চোখ মেলাতেন কম, প্রশ্ন প্রায় করতেন না ই বলা চলে।

চিকিৎসক কে বিভ্রান্ত এবং কেইস হিস্ট্রি লুকিয়ে রাখার দায়ে যদি কোনো কেইস করার পদ্ধতি থাকত তবে বেশ হতো, আমার সে সময় এমনটাই মনে হয়েছিলো।

মেয়েদের মা হওয়া খুব কঠিন কিছুই না কিন্ত! রিপ্রোডাক্টিভ এইজ শুরু হয় সেই ১২/১৩ বছর থেকেই। কিন্ত যেই রক্তের দলা আমি ধারণ করবো তার জন্য যেই প্রস্তুতি তা শুধু শারীরিকই নয় মানসিক তৈয়ারির ও ব্যাপার আছে। আমি জানলাম ই না, বুঝলাম ই না কিন্ত তাকে আহবান করে এরপর উপড়ে দিলাম, শুধুমাত্র, ” আমি বুঝতে পারিনি অথবা আমার এখন এটা চাই না” এই অজুহাতে!!

কোথাও দেখেছিলাম যে, ‘ ছেলেরা করে মোটর বাইক এক্সিডেন্ট আর মেয়েরা করে এক্সিডেন্ট, এক্সিডেন্টলি বাচ্চা নিয়ে’! কি অদ্ভুত না!

আজ যেই জরায়ু একে আপন করে নিয়েছে কাল আপনি যখন তার শরীর থেকে টেনে হিঁচড়ে আপনার এই অংশটুকু আবর্জনা মনে করে ধুয়ে নিচ্ছেন, একবার ও কি ভেবেছেন যে এই প্রক্রিয়াটি কিভাবে সম্পন্ন করা হচ্ছে !

মনে করেন আপনার কোলের যে বাচ্চাটি আপনার গলা জরিয়ে বুকের সাথে মিশে আছে আমি তাকে টেনে খুবলে নিয়ে বুড়িগঙ্গায় ছুঁড়ে ফেলে দিলাম। জ্বি ব্যাপারটা ঠিক সেরকম ই কিছু, শুধু আপনার কোলের বাচ্চাটি, মা বলে কাঁদতে পারবে আর এই রক্তের বিন্দুটির সেই শক্তি নেই।

নারকোল যেভাবে কোড়ায় ঠিক সেভাবেই জরায়ু কুড়িয়ে খুড়ে ফেলা হয় আপনার এই অপাংক্তেয় অস্তিত্বকে। যেই জরায়ু একসময় পরম মমতায় এই বিন্দু ধারণ করে, আপনার একটি ভুল সিদ্ধান্তের কারণে সে হয়ে যায় হস্টাইল (নিজের অংশকেই শত্রু ভাবে)। এরপর অনেক চেষ্টা করেও তার মান আর ভাঙ্গানো যায়না।

তাই অনুরোধ, নিজের সবচেয়ে সুন্দর আর অদ্ভুত সৃষ্টিকে অপ্রয়োজনীয় ভাবার আগে দুবার, তিনবার, পাঁঁচবার, দশবার ভাবুন।

নয়তো আজ যাকে এবর্ট করছেন একসময় তাকে এডপ্ট ও করতে হতে পারে।

#উপড়ানো_অস্তিত্ব #এবরশন

মিমি হোসেন

মিমি হোসেন

সিনিয়র মেডিকেল অফিসার

কার্ডিওলজি

ল্যাব এইড কার্ডিয়াক হসপিটাল

 

Photo by Alex Hockett on Unsplash

Related posts

Leave a Comment