আঁচিল কি ? কেন হয় ? শরীরের কোথায় হয় ? চিকিৎসা কি ?
প্রিয় পাঠক, আপনার শরীরে আকারে ছোট, মাংসল বর্ধিত এমন কিছু কি আছে যেটা কখনো ব্যথা করে না বা চুলকায় না? এটা হতে পারে দেখতে আপনার শরীরের বর্ণের অথবা আকৃতিতে গোলাকার বা লম্বাটে, সাধারণত যেগুলো খুব সরু বৃন্তের মাধ্যমে আপনার চামড়ার সাথে যুক্ত থাকে। তাহলে এই বর্ধিত জিনিস গুলো কি? যদি আপনার শরীরে এরকম কিছু থেকে থাকে, এগুলো Skin tags । সাধারণ ভাবে আমাদের কাছে ‘আঁচিল’ নামেই বেশি পরিচিত। তাহলে দেরী কেন পাঠক, আজ আঁচিল নিয়েই কথা বলা যাক। চলুন শুরু করিঃ
আঁচিল মূলত কি?
আঁচিল আকারে ছোট, এক ধরণের বিনাইন টিউমার ( যে সব টিউমার ক্যানসার সৃষ্টি করে না তাদের বিনাইন টিউমার বলা হয়। অর্থাৎ, এই টিউমার গুলো আশেপাশের টিস্যুকে আক্রমণ করে না বা ছড়ায় না)। আঁচিলকে ননক্যানসারাস (noncancerous) বলা হয়। আঁচিল মূলত একটি বৃন্ত (Stalk) এর সাহায্যে চামড়ায় লেগে থাকে, যাকে Peduncle বলা হয়। আঁচিল হলে কোনো ধরণের ব্যথা অনুভূত হয় না। অনেকে তো বুঝতেও পারে না যে তার আঁচিল হয়েছে, যতক্ষণ না চোখে পড়েছে। মেডিকেল এর ভাষায় আঁচিলকে অনেক নামে ডাকা হয়। যেমনঃ acrochordon, fibroepithelial polyp, cutaneous papilloma ও soft fibroma ।
আঁচিল কাদের হয়?
আঁচিল হওয়ার প্রবনতার দিকে নারী-পুরুষ উভয়েই সমানে সমান। তবে, বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে আঁচিল হওয়ার হারও বেড়ে যায়, যেমনঃ মধ্যবয়সের পর আঁচিল হওয়ার প্রবণতা বেশি ।
শরীরের কোথায় আঁচিল হতে পারে?
আঁচিল শরীরের যেকোনো জায়গায় হতে পারে, তবে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় ঘাড়ে, বগলে, কুঁচকিতে, বুকের উপরের দিকে ( নারীদের ক্ষেত্রে স্তনের নিচে) । এগুলো চোখের পাতায় এমনকি নিতম্বের ভাঁজেও হতে পারে। আপনার শরীরে আঁচিল একটা, দুইটা বা অনেকগুলো একসাথে হতে পারে।
আঁচিল কেন হয়?
ঠিক কি কারণে আঁচিল হয় তা এখনও জানা যায় নি। তবে কিছু উল্লেখযোগ্য কারণগুলো হচ্ছেঃ
- আপনারা একটু খেয়াল করলেই দেখবেন, শরীরের ভাঁজে ভাঁজে অর্থাৎ যেখানে ত্বকে-ত্বকেঅথবা কাপড়ের মাধ্যমে চামড়ায় ঘর্ষণ সৃষ্টি হয়, সে সব স্থানেই আঁচিল জন্মাতে দেখা যায়।
- যে সব মানুষের ওজন তুলনামূলক ভাবে বেশি এবংযারা স্থুলকায় তাদের আঁচিল হওয়ার হারও অনেক বেশি, কারণ তাদের শরীরের ভাঁজের সংখ্যাও বেশি।
- অতিরিক্ত ওজনটাইপ-২ ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুকি বাড়িয়ে দেয়। গবেষণায় দেখা যায়, যাদের এধরনের ডায়াবেটিস আছে তাদের আঁচিল অন্যদের চেয়ে বেশি হয়। যেহেতু, টাইপ-২ ডায়াবেটিস হলে রক্তে সুগার লেভেল বেশি থাকে, সেহেতু আমরা সহজে বলতে পারি আঁচিল এর সাথে ইনসুলিন নামক হরমোনের সম্পর্ক আছে (ইনসুলিন হরমোন রক্তে সুগার এর পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করে) ।
- ইনসুলিন মাংসের বৃদ্ধিতে সাহায্য করে এবং এটা ত্বকের কোষের প্রতিরুপ সৃষ্টিতেও ভুমিকা রাখে। এভাবে পরবর্তীতে আঁচিল বিকাশেওভুমিকা রাখে। একারণে আঁচিল হওয়াকে ডায়াবেটিসের পূর্ব সতর্ক সংকেত হিসেবে ধরা হয়। সবার হবে তা কিন্তু নয়, তবে ডায়াবেটিসের পরীক্ষা করে সচেতন থাকা উচিত।
- গর্ভবতী মায়েদের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় ট্রাইমেস্টারে(second trimester) আঁচিল হতে দেখা যায়। (গর্ভকালীন সময়ের ১৩-২৭ সপ্তাহ পর্যন্ত সময়কে second trimester বলা হায়। অর্থাৎ ৪,৫,৬ নাম্বার মাস)
- যাদেরCrohn’s disease থাকে তাদের আঁচিল হওয়া মোটামুটি সাধারণ {এটা একধরণের chronic condition যেটা পরিপাক নালিতে প্রদাহ সৃষ্টি করে এবং পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হিসেবে অতিসার(diarrhea) , পেট ব্যথা(abdominal pain), খিঁচুনি( cramping) , কোষ্ঠকাঠিন্য( constipation), মলদ্বারে রক্তক্ষরণ (rectal bleeding) হয়ে থাকে }। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, যাদের Crohn’s disease আছে, তাদের আঁচিল সাধারণত পায়ু পথের মুখে হয়ে থাকে।
- আঁচিল এর সাথেজিনগত একটা সম্পর্ক আছে, অর্থাৎ, একই পরিবারের অন্যান্য সদস্যেরও হতে পারে।
কিভাবে আঁচিলকে শনাক্ত করতে করবেন?
মনে আছে নিশ্চয়ই শুরুতে বলেছিলাম, আঁচিল বৃন্তের সাহায্যে চামড়ার সাথে যুক্ত থাকে। তাই আঁচিলকে চেনার প্রধান মাধ্যমই হচ্ছে এর বৃন্ত(peduncle)। বেশির ভাগ আঁচিল খুব ছোট হয়, আকারে ২ মিলি এর চেয়েও ছোট। তবে কিছু কিছু বড়ও হয়, আকারে কয়েক সেন্টিমিটার হতে পারে। আঁচিল হাত দিলে নরম লাগে। এরা নমনীয়, গোলাকার, বলিরেখার মতো( wrinkly) ও অপ্রতিসম হতে পারে। তবে, কিছু আঁচিল সুতোর মতো চিকন অথবা চালের দানার মতো হতে পারে। এদের রঙ সাধারণত ত্বকের রঙের (fleshed-colored) অনুরুপ হয়। অনেকসময় আঁচিলের রঙ আশেপাশের ত্বকের রঙ থেকে কালচে হয়ে থাকে। আর এটা হয়ে থাকে Hyperpigmentation এর জন্য।( Hyperpigmentation হচ্ছে এক ধরণের harmless condition যাতে শরীরের কিছু কিছু জায়গার রঙ অন্যান্য জায়গার চেয়ে কালচে হয়)। যদি কোনো আঁচিল মুচড়িয়ে যায়, তাহলেও এটা কালো হতে পারে, সেখানে রক্ত-প্রবাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ার জন্য।
আঁচিল ও Warts এর মাঝে পার্থক্য কি?
যদি আপনি Warts এর আভিধানিক অর্থ খুঁজতে যান তাহলে Warts এর অর্থ ‘আঁচিল’ পাবেন। কিন্তু বাস্তবেWarts এবং skin tags/ আঁচিল এর যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। যেমনঃ
- সাধারণতskin tags এর তল মসৃণ ও নমনীয় হয়। কিন্তু,Warts এর উপরিতল রুক্ষ এবং অনিয়মিত হয়ে থাকে।
- Skin tags গাঁটযুক্ত( knobbly) এবং ত্বকের সাথে ঝুলে থাকে। কিন্তু, Warts ত্বক থেকে সামান্য উঁচু অথবা সমতল হয়।
- Skin tags সংক্রামক নয়, Warts অনেক সহজে ছড়ায়।
আঁচিল কি সংক্রামক?
না, শরীরে সাধারণত যে আঁচিলগুলো হয়ে থাকে তা যে সংক্রামক, এর পক্ষে কোনো প্রমাণ নেই।
কিছু ক্ষেত্রে যে সব মেয়েরা অলংকার পড়ে তাদের কেন সেখানে আঁচিল হয়?
এর পিছনের মুল কারণটি হচ্ছে ঘর্ষণ ( Friction)। ঘর্ষণের জন্য ত্বকের কোষ গুলো শিথিল হয়, কিছুটা প্রসারণ ঘোটে। ত্বকে Elastin এর ঘটতির জন্যও এরকম হতে পারে। তাই, যেখানে প্রতিনিয়ত ঘষা লাগে সেখানে আঁচিলের দেখা হওয়ার আশা আমরা করতেই পারি! যারা অলংকার পড়েন যেমনঃ মালা(necklace) , তাদের মালার সাথে ঘাড়ের ত্বকের প্রতিনিয়ত ঘর্ষণের দরুন আঁচিল হয়ে থাকে।
কখন ডাক্তারের কাছে যাবেন?
অন্যান্য চর্মরোগ যেমনঃ Warts ও Moles এর সাথে আঁচিল গুলিয়ে যেতে পারে। আপনারা সহজে নাও চিনতে পারেন। কিছু কিছু Moles ক্যানসারও সৃষ্টি করতে পারে। তাই সবচেয়ে ভালো হচ্ছে, আঁচিল হলে ডাক্তারের মাধ্যমে পরীক্ষা করিয়ে নিবেন। আপনার ফ্যামিলি ডাক্তার অথবা চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ ডায়াগনোসিস করতে পারবেন। তারা Visual exam এর মাধ্যমে প্রাথমিক অবস্থায় diagnosis করবেন। যদি প্রাথমিক অবস্থায় সন্দেহ হয়, তাহলে biopsy করতে পারেন। ( biopsy হচ্ছে শরীরের কোনো স্থান থেকে টিস্যু নিয়ে আরও ভালো করে পরীক্ষা করা)
আঁচিলের চিকিৎসা কি?
আঁচিল যেহেতু এমনিতে কোনো ক্ষতি করে না, তাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সৌন্দর্যগত কারণে এটা অপসারণ করা হয়। যে সব আঁচিল আকারে বড় সেগুলো অলংকার ও কাপড় পড়ার সময় ঘর্ষণের সৃষ্টি করে, এটা থেকে রক্ষা পেতে অনেকে অপসারণ করে থাকেন। মুখে, বগলে যদি আঁচিল থাকে, অপসারণ করলে সেইভিং (Shaving) করতে সুবিধা হয়। নিচে আঁচিল অপসারণে কিছু নিরাপদ পদ্ধতি দেয়া হলঃ
- Cauterization: এতে একটি ডিভাইস এর মাধ্যমে আঁচিল পুড়িয়ে ফেলা হয়।
- Cryosurgery: এতে তরল নাইট্রোজেন( Liquid nitrogen) এর মাধ্যমে আঁচিল হিমায়িত (Frozen) করা হয়।
- Ligation: আঁচিলের রক্ত প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করা হয়।
- Excision: এই পদ্ধতিতে আঁচিল কেটে ফেলা হয়scalpel এর সাহায্যে।
**খুব ছোট আঁচিলগুলোর ক্ষেত্রে ডেন্টাল ফ্লস( Dental Floss) বা চিকন সুতো (Cotton thread) গোঁড়ায় বেধে রক্তের প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করেও আঁচিল অপসারণ করা হয়।
আঁচিল একবার হলে কি আবার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে?
এরকম কখনো হয় নি যে, একবার অপসারণ করার পর আবার আঁচিল হয়েছে। তবে, যাদের আঁচিল হওয়ার হার বেশি তাদের এমনিতে আঁচিল হতে পারে, কিন্তু সেটা অপসারণের জন্য অবশ্যই না।
**মনে রাখবেন, বাসায় কেউ নিজে নিজে আঁচিল অপসারণের চেষ্টা করবেন না
বাসায় নিজে নিজে আঁচিল অপসারণের পক্ষে সাধারণত মত দেয়া হয় না। কারণ এতে রক্তপাত এবং ইনফেকশন (Infection) হতে পারে। অনেক ইউটিউব ভিডিও তে বিভিন্ন রকম পদ্ধতি দেখানো হয়, যাতে আপনি ঘরে বসে নিজে নিজে আঁচিল অপসারণ করতে পারেন। এতে আপনি নিজের অজান্তেই ইনফেকশন সৃষ্টি করে ফেলতে পারেন। মনে রাখবেন, নিজে চেষ্টা করার অর্থ হচ্ছে আপনি Self-diagnosis করছেন, এতে আপনি যাকে আঁচিল ভাবছেন সেটা আঁচিল না হয়ে skin cancer অথবা moleও হতে পারে। তাই নিজে বাসায় চেষ্টা করার পূর্বে অবশ্যই আপনার ডাক্তারকে দেখাবেন।
আজ এতটুকুই, ধৈর্য সহকারে লিখাটি পড়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।
লেখকঃ আকিব নিয়াজ জোহা
Jinzhou Medical University (CHINA)
Photo by pranav jain on Unsplash
Thank you for your valuable post.