বাড়িয়ে দাও তোমার হাত

বাড়িয়ে দাও তোমার হাত

আমি কোন মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ নই, আমি কোন কাউন্সিলরও নই, আমার নিজের অবজারভেশান থেকেই আমি কথা গুলো লিখেছি। মত প্রকাশের স্বাধীনতা সবার আছে, আমি সেই সুযোগটাই নিলাম।

(১)

কোন রেস্টুরেন্টে খেতে গেলে আমার আশেপাশে প্রায়ই দেখি কিছু যুবক-যুবতী। ওদের দিকে তাকালে, আমার মধ্যে একটা অদ্ভুত ইনটুইশান কাজ করে। ওদের দিকে তাকানোটা অশোভন হলেও আমার মাথায় তখন থাকে একটা নতুন কিছু আবিষ্কারের নেশা। ওদের চোখে মুখে যে ভালোবাসার তৃষ্ণা দেখি সেটা কতটা সত্য ও সুন্দর সেটাই বুঝতে চেষ্টা করি। আমি ভাবি কতদিন ওরা এভাবে হাসি খুশী থাকবে? এই একটু স্পর্শের ব্যাকুলতাটা শ্রেফ যৌবনের একটা আবেগের বহিঃপ্রকাশ নয়তো? ওরাও যে নেশার ঘোরে আছন্ন সেখানে বাস্তবতার স্পর্শ কতটুকু?

হয়তো এটাই প্রেম! চিরদিন কাছে থেকেও কেউ প্রেমের সুবাস পায় না, আবার কেউ কেউ কয়েক দিনের মধ্যেই প্রেমের ঘোরে হাবুডুবু খান! প্রেম এমনই, বলে কয়ে আসে না, সময়ও নেয় না! এরপর বাস্তবতায় আসলে শুধুই ডিপ্রেশান! অবাস্তব প্রেমের ঘোরের মাঝে ভালোবাসার পরিমান কতখানি? আর অভিনয়?

(২)

আমি যখন কোন দর্শনীয় স্থানে হাঁটতে যাই আমি দেখি অগনিত পরিবারের মিলনমেলা। আমি অবাক হয়ে প্রতিটা সদস্যের মুখের দিকে তাকাই, চোখের দিকে তাকাই, আমি বুঝতে চেষ্টা করি ওদের অভিব্যক্তি! আমার ভীষন প্রিয় একটা বিষয় হচ্ছে মানুষের মনকে খুব কাছে থেকে দেখা, অভিব্যাক্তি দিয়ে মনের বাড়ি পৌঁছে যাওয়া। আমি তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করি কে কতটা সুখী। চারপাশে কত হাসি মুখ আছে, আছে কত বিমর্ষ হৃদয়। আমি ভাবতে থাকি, কোথায় কি সমস্যা এবং কেন?

আমার ভীষন ভালো লাগে কেউ যখন বিশ্বাস করে আমাকে নিজের কষ্টের কথা জানায়। কেউ যখন আগ্রহ নিয়ে তার আনন্দের কথা কিম্বা বুকের ভেতরের জমানো একান্ত ব্যক্তিগত কথা আমাকে বলে ফেলে আমি তাঁর কাছে ঋণী হয়ে যাই। আজ পর্যন্ত কারো বিশ্বাস ভেংগেছি বলে মনে পড়ে না। আর বিশ্বাস ভাংগবো এমন চিন্তাও করি না।

(৩)

আমি ইটুইশান নিয়ে ভাবি, আমি ফেইস রিডিং নিয়ে ভাবি, আমি টেলিপ্যাথি নিয়ে ভাবি। আমি বিশ্বাস করতে চেষ্টা করি কাউকে নিয়ে অনেক বেশী ভাবলে তার মনের ভেতর ঢোকা যায় যদি সে আপনাকে তার মনে স্থান দিয়ে ঢোকার রাস্তাটা করে দেয়। সেটা না হলে কারো মন পড়তে পারা বা কাউকে বুঝতে পারা ভীষন কঠিন হয়ে যায়।

মন বোঝার এই ব্যপারটা ভীষন রিস্কি, দেখা যাবে আপনি কাউকে নিয়ে যেমনটা ভাবছেন সে আদৌ সেই রকম নয়। কিন্তু আমার মনে হয়েছে কেউ যদি আপনাকে সেই সহযোগীতা করে যাতে আপনি তাকে সহজেই বুঝতে পারেন তাহলে আপনি অনেক সঠিকভাবেই তাকে বুজতে পারবেন এবং তার সম্পর্কে ভবিষ্যতবানী করতে পারবেন।

(৪)

ডিপ্রেশান শব্দটার মাঝে অদ্ভুত এক আবেশ আছে। কেউ কেউ এই শব্দটা শুনলেই ভয় পান, কেউ বুঝতেও পারেন না এই শব্দ তার জীবনের কতটা জুড়ে বর্তমান। অর্থাৎ, তিনি নিজেই জানেন না তিনি যে ডিপ্রেসড! আবার কেউ কেউ যখন তখন দুঃখ বিলাসের অংশ হিসেবে ডিপ্রেশান শব্দকে ব্যবহার করে থাকেন।

যাদেরকে আমার কাছে ডিপ্রেসড মনে হয়েছে আমি চেষ্টা করেছি তাদের মনের ভেতর ঢুকতে কিন্তু আমি দেখলাম এই কাজটা ভীষন কঠিন, এরা কাউকেই সহজে এক্সেস দিতে চায় না। অন্ধকার ঘরে, একা বসে ভাবতেই এদের ভালো লাগে, কখনো গান শোনা, কখনো বই পড়া। খাওয়া দাওয়ায় মন নেই, নিজের প্রতি যত্ন নেই। আমার প্রথম অবজারভেশান এতটুকুই।

যে কয়জন সুইসাইডাল এটেম্পট নেয়া মানুষকে কাছে থেকে দেখেছি তাদের সবাইকে এনালাইসিস করে একটা সত্য কথাই বুঝেছি একটা মাত্র বিষয়ে অধিক চিন্তা থেকেই তারা মৃত্যুর মতো বড় ঝুঁকি নেয়। তারমানে, ব্যপারটা দাঁড়ালো এই যে, যারা একাধিক বিষয় নিয়ে সমস্যায় থাকেন তাদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা অনেকাংশেই কম!

(৫)

কেউ যখন সিদ্ধান্ত নেয়, নিজেকে শেষ করে দেবে, সেটার বীজ বপন কিন্তু একদিনে হয় না, বারবার বার একই আঘাতে জর্জরিত হয়ে হয়ে হঠাৎ করেই সে সিদ্ধান্তটা নেয়। সে সময় তার পারিপার্শ্বিকতাকে সে এতটাই এড়িয়ে চলে যে আশেপাশের মানুষ বুঝতেই পারেনা। আর বুঝতে পারলেও তাকে ফিরাতে ওদের অনেক বেগ পেতে হয়।

আমি বহু জনকে দেখেছি সাহায্য করতে গিয়ে অপমানিত হতে, কার এত দরকার ঘরের খেয়ে পরের উপকারের? আর মেডিকেলে তো সবাই যে যার মত বিজি! কাজেই, যে বিপদে পড়েছে তাকে সময় দেয়ার কিম্বা তাকে টেনে তোলার মানুষ খুব একটা থাকে না বললেই চলে।

(৬)

একটা ডিপ্রেসড মানুষকে কাউন্সেলিং করতে গিয়ে আপনি যখন বারবার সাইকিয়াট্রিষ্ট বা কাউন্সিলর এর পরামর্শ দেবেন বুঝে নেবেন আপনি একটু হলেও দায়িত্ব এড়াচ্ছেন। খুব খেয়াল করবেন, আমি বারবার সাইকিয়াট্রিষ্ট এর পরামর্শের কথা বলেছি। ব্যাপরটা এমন যে, কারো জ্বর হলেই আপনি তাকে রাত দুপুরে বললেন, ডাক্তারের কাছে যাও অথচ ওই সময় ওকে একটা সামান্য প্যারাসিটামল আর কুসুম গরম পানি দিয়ে গা মুছিয়ে দিলেই হয়।

আপনি ডিপ্রেসড কাউকে একটু মানসিক সাপোর্ট দিতে গিয়ে বারবার যদি তাকে অসুস্থ্যতার কথা বলেন সে কিন্তু আপনাকে খুব বেশী আপন ভাববে না। সে নিজেও জানে সে যে অসুস্থ্য। চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে এইটা কে না জানে, সে ও সেটা ভালোই জানে। আপনি ওকে একটু সময় দিন, ডাক্তারের কাছে যেতে সাহায্য করুন ওর সমস্যাটা বুঝতে চেষ্টা করুন। দেখবেন সে আপনাকে বিশ্বাস করতে শুরু করবে। আর বিশ্বাস যখন অর্জন করে ফেলবেন, তাকে মোটিভেট করা কঠিন কোন কাজ হবে না! কোন কিছুই দ্রুত হয় না, যে ডিপ্রেসেড সে একটা অবসেশান এ থাকে, একটা জিনিসই তার মাথায় বারবার ঘুরতে থাকে, তাকে একা রাখলে সে ওই একই জিনিস বারবার ভাববে, তাকে সময় দিন, তাকে বোঝান আপনি তারজন্য কতটা ডেডিকেটেড।

(৭)

আপনি যদি মনে করেন আপনার ব্যক্তিগত কাজের চাপ সামলে আপনি এতটা সময় দিতে পারবেন না দয়া করে উপকার করার নামে সময় ক্ষেপন করবেন না। ওকে এমন কারো সাথে মিশতে দিন যাকে সে ভালোবাসবে এবং ভালো জানবে, যে ওর জন্য উপকারী, যে তার প্রকৃত বন্ধু। নিজে ওর আশেপাশে ঘুরে আরেকজনের আসার রাস্তাটা দয়া করে বন্ধ করবেন না। কাউকে ভালোবাসলে মন থেকে বাসুন, দয়া, দায়িত্ববোধ, সিমপ্যাথি এসব থেকে কাউকে সাহায্য করতে আসবেন না। বিশ্বাস করুন প্রকৃত ও নিঃস্বার্থ ভালোবাসা দিয়ে কাউকে সাহায্য করতে না পারলে বেশী দূর যেতেও পারবেন না। এতটুকুও যদি করতে না পারেন তাহলে কিঞ্চিত দায়ভার আপনাকে নিতেই হবে!

সমস্যাটা হয়ে যায় তখনই যখন একটা ছেলে বা মেয়ে ডিপ্রেসড হয় এবং তাকে সাহায্য করতে আসে বিপরীত লিংগের কেউ একজন। এক্ষেত্রে কিছুদিন ভালো কাটার পরেই শুরু হয় একটা টানাপোড়েন। এটা ভীষন স্পর্শকাতর একটা ইস্যু। নিজেকে কিভাবে কাজে লাগাবেন সেটা আপনার ব্যক্তিগত ব্যপার কিন্তু কারো উপকার করতে গিয়ে না ক্ষতি করে ফেলেন!

[ কাল ছিলো ৭ই এপ্রিল, বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস। আমি গতবারের(২০১৭) স্লোগানটা ভুলতেই পারছি না, ডিপ্রেশানঃ লেটস টক! আজকের লেখাটা একটু অন্যভাবে শুরু করলাম। অনেকদিন লিখিনি বলে হাত চলছিলো না ! আমার ব্যক্তিগত অভিমতই এখানে তুলে ধরলাম। ভুল হলে ক্ষমা প্রার্থী।]

 

ডা মৃণাল সাহা

Related posts

Leave a Comment